প্রথমেই বলে রাখা ভাল, আমার এ লেখাটি তাদের জন্য যারা কলেজ সিলেকশন নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ যে আমরা অমুক কলেজে ভর্তি হব এটা তাদের জন্য না। কারণ আমি হাজার উপদেশ দিলেও তারা আমার কথা শুনবে না। তাই তাদেরকে দূরে থাকার পরামর্শ কগ। তাছাড়া আমার এই কথাগুলোর সবটাই যে ঠিক সেটা নাও হতে পারে। ব্যক্তি, সময় বা পরিস্থিতি অনুসারে এটা ভিন্ন হতে পারে। তবে এভারেজ পরিসংখ্যানটা কিন্তু সাধারণত ঠিকই থাকে। যাইহোক কাজের কথায় আসি।
কিছুদিন পূর্বে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। যারা পাস করেছে তাদের মাথায় এখন একটাই চিন্তা তারা কোন কলেজে ভর্তি হবে। কোন কলেজ ভাল, কোথায় ভাল পড়ালেখা হয়, কোন কলেজের শিক্ষক ভাল, কোন কলেজে বড় বড় বিল্ডিং ইত্যাদি ইত্যাদি। নানান প্রশ্ন মাথায় উকি মারে। আমি যখন কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম তখন ভাবতাম, যে কলেজের আয়তন যত বেশি, যে কলেজে বড় বড় বিল্ডিং আছে সেই কলেজ বোধ হয় ভাল। যারা মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী তারা বাড়ির কাছের মোটামুটি মানসম্মত যে কোন একটা কলেজে ভর্তি হলেই চলবে। কিন্তু যারা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাদেরকে একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে দরকার। অনেকের ধারণা বড় বড় শহরের বড় বড় কলেজে গেলে বোধ হয় ভাল পড়াশোনা হয়। এক কথায় বলব না। ধারণটা সম্পূর্ণ ভুল। পড়াশোনাটা নিজের কাছে। তাছাড়া জীবনে ভাল কিছু করতে গেলে বন্ধু সার্কেলটা অত্যন্ত জরুরী বিষয়। তাই ভাল বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ না করাই ভাল। তাছাড়া বড় বড় কলেজের চাপটাও বড় বড় (বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে)। সেখানে বিভিন্ন ধরণের কোর্স চালু থাকায় স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকের দ্বারা সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর প্রতি নজর দেয়া একটু কঠিন হয় যায়। আবার বড় বড় কলেজ হলেই যে সেখানে ভাল পরিবেশ থাকবে সেটাও কিন্তু ঠিক নয়। বড় বড় কলেজে ভাল ভাল শিক্ষক থাকলেও (আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে) সেখানে মানসম্মত শিক্ষা নাও পাওয়া যেতে পারে। কারণ বছরে তিন থেকে চার মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকে। ফলে সিলেবাস শেষ করা কোনভাবেই সম্ভব হয় না। তাছাড়া যে কয়মাস প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে তার সব কটাদিন ক্লাস হয় না। আবার যে কটাদিন ক্লাস হয় সে কটাদিন সবগুলো ক্লাস হয় না। আবার যে কটাক্লাস হয় তার সবগুলো ক্লাসে সব শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে না। আবার সবাই সবদিন পড়াও করে না। এর মধ্যে দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আবার বাড়িতে বেড়াতে যায়। আবার ভাল শিক্ষক থাকলেও একটা ক্লাসে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকে ৪৫ মিনিটের একটা ক্লাসে সবাইকে আসলে ভালভাবে পড়াটা বুঝিয়ে দেয়া সম্ভবও হয় না। সব মিলিয়ে আসলেই সিলেবাস হয় না। আসলেই একটা হ য ব র ল অবস্থা। যারা এই লাইনে আছেন তারা ছাড়া আসলেই ব্যাপারটি কেউ বুঝতে চায় না। যারা বলবেন আগেতো আমরা পড়ালেখা করেছি। কই আমাদেরতো কোন অসুবিধা হয়নি। তাদেরকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই যে, অসুবিধা হয়েছে যেটা আমরা ঐ সময় বুঝতে পারিনি। আর এখন যারা শিক্ষক তারা ছাড়া খুব কম লোকই সঠিক ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কোন কলেজে ভর্তি হব। সব কলেজেইতো তাহলে একই অবস্থা। আসলেই তাই (হাতে গোনা দুচারটি কলেজ ছাড়া। কিন্তু ঐ দুচারটি কলেজ দিয়ে আমাদের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়ণ করা ঠিক হবে না)। প্রথমেই বলব, বাড়ির কাছের মোটামুটি মানসম্মত একটা কলেজে ভর্তি হওয়া ভাল। কারণ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা যেটুকু করে সেটা ঐ বিভিন্ন শিক্ষকের ব্যাচে গিয়েই পড়ে। এটা যে যেভাবেই নিক না কেন এটাই বাস্তবতা। অযথা চেচামেচি করে কোন লাভ নেই। কারণ আমরা যারাই চেচামেচি করি শেষ পর্যন্ত সেই আমাদেরই ছেলেমেয়েদেরকেই বিভিন্ন শিক্ষকের ব্যাচেই পাঠাতে হয়। কোন উপায় নেই। এটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এটাই বাস্তবতা। তানাহলে খোদ শিক্ষকরাই তাদের সন্তানদের অন্য শিক্ষকের কাছে পাঠাতেন না। তারা ভালভাবে জানেন এখানে কতটুকু সম্ভব। এখন প্রশ্ন হল যারা নিজের শহরের বাইরে গিয়ে পড়বে তারাওতো বিভিন্ন শিক্ষকের ব্যাচে গিয়ে পড়তে পারে। তাহলে অসুুবিধা কোথায়? আমি বলব অসুবিধা আছে। ব্যাপারটা অত সহজ না। প্রথমত, অচেনা জায়গায় গিয়ে ভাল শিক্ষক পাওয়াটা কঠিন। দ্বিতীয়ত, সবগুলো বিষয়ের ভাল শিক্ষক পাওয়া আরও কঠিন। কারণ মাত্র একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে পড়ালেখা হয় না। কারোর একটা বিষয় ভাল হচ্ছেতো আর একটা বিষয় না। তৃতীয়ত, ভাল শিক্ষক পাওয়া গেলেও বাসা থেকে এমন দূরে যেটা একজন শিক্ষার্থীর (বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীর) পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সম্ভব হলেও অনেক সময়ের অপচয় হয়। চতুর্থত, পরিচিত দুই একজন বন্ধু না থাকলে প্রথমে কিছুদিন ভাল লাগলেও একটা সময় পরে গিয়ে সেটা আর ভাল লাগে না। (এটা অবশ্যই ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে।) পঞ্চমত, যে বিষয়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ যেটা হল শরীর স্যুট করা। কারণ অনেকেই মায়ের হাতের রান্না ছেড়ে হঠাৎ করে বাইরের পরিবেশে গিয়ে হোস্টেলর খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এটা একটা মারাত্মক সমস্যা। সর্বশেষ, হোস্টেলে থাকতে হলে বাজার করা, হোস্টেলের এক এক মাসের ম্যানেজার (যে হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের একটি বিশেষ সময়ের জন্য খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে) এর দায়িত্ব পালন করা, নিজের জামা-কাপড় পরিষ্কার করা, মোদ্দা কথা নিজের প্রয়োজনীয় সকল জিনিস নিজে দেখভাল করা (যেটা নিজের বাসাতে থাকলে আম্মুই করে দেয়) এসবের পিছনে যথেষ্ঠ সময় ব্যয় করতে হয় যেটা একটা শিক্ষার্থীর জন্য বাড়তি চাপ, বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য। তাছাড়া পরিবারে সবার মধ্যে থাকলে মনটাও ফিরফিরে থাকে যেটা পড়ালেখার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর সৃষ্টিকর্তা না করুন অসুখ-বিসুখতো আছেই।
তাহলে সমাধানটা কী? সমাধান নিজের কাছে। নিজে ভালভাবে পড়লে কোন শিক্ষকের কাছে যাওয়া লাগে না। তবে অনেকেই আছে যারা নিজে অনেক সময় সবকিছু ঠিকঠাক বুুঝে উঠতে পারে না। আবার অনেকেই আছে যারা এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদেরকে আরও একটু এগিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন শিক্ষকের ব্যাচে যায়। এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বলব অবশ্যই বাড়ির কাছাকাছি মোটামুটি মানসম্মত একটা কলেজে ভর্তি হতে। কারণ তোমাদেরকে যদি সেই ব্যাচেই পড়তে হয় তাহলে বাইরে গিয়ে সেটা সামলানো সহজ কাজ হবে না। কিন্তু নিজের শহরে থাকলে পরিচিত বড়ভাই বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পরামর্শ পাবে যেটা বাইরে গেলে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। তবে কারোর সাহায্য ছাড়াই যদি তুমি চলতে পারো তাহলে বাইরে যেতে অসুবিধা নেই। আর একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। বিশেষ করে সকল জেলা সদরের সব কলেজ প্রায় একই ধরণের, একই মানের। শিক্ষকও প্রায় একই যোগ্যতাসম্পন্ন (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। আর সরকারি কলেজের কথা যদি ভাব তাহলে দেখা যাবে তুমি যে শিক্ষকের আশায় তোমার পছন্দের কলেজে ভর্তি হয়েছ কিছুদিন পরে ঐ শিক্ষক বদলি হয়ে অন্য কলেজে চলে গেছে (যেখানে তুমি ভর্তি হতে চাওনি)। তখন করবে কী?
সবশেষে একটিটি বাস্তব ঘটনা বলে শেষ করব। নাম তনা (ছদ্মনাম)। ২০১৭ সালে সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এবার সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে এসএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষার জন্য আমার পক্ষ থেকে শুভ কামনা থাকল। যাইহোক সে এসএসসি পাসের পর খুলনার একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ১ম বর্ষ শেষ হওয়ার পূর্বেই তাকে আবার তার নিজের শহরে ফিরে আসতে হয়েছিল। এমনও দেখা গেছে যে সে কোন কোন বিষয়ের জন্য ঐ কয় মাসে তাকে চারটি শিক্ষক পরিবর্তন করতে হয়েছে। তার মানে এটা নয় যে খুলনাতে ভাল শিক্ষক নেই, সব ভাল শিক্ষক বোধ হয় সাতক্ষীরাতে। বিষয়টা এরকম না। আসলে সে অপরিচিত জায়গায় গিয়ে ভাল শিক্ষকগুলোর দেখা পায়নি। তাকে যখন যে যে শিক্ষকের কাছে পড়তে বলেছে সে তখন সেই শিক্ষকের কাছে গেছে। আর এর মধ্যে শুধু সময়টা নষ্ট হয়ে গেছে একবছর কোন কাজে আসেনি। এর মধ্যে ওর সমতুল্য শিক্ষার্থীরা ভাল প্রস্তুতি নিয়ে ২য় বর্ষে উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত ২য় বর্ষে এসে সে টিসি নিয়ে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে এবার সে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এতে করে তার অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তাছাড়া তার আসার আর একটি বড় কারণ ছিল তার অসুস্থতা। যাইহোক, বাকিটা এখন দেখার বিষয়। আমার এক নিকটাত্মীয়ের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। এরকম অসংখ্য উদারহণ আছে। তাই সদ্য এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রতি আবারও পরামর্শ থাকল বাড়ির কাছাকাছি মোটামুটি মানসম্মত একটা কলেজে ভর্তি হওয়ার। কারণ এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই লেভেলটাই জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ধারণ করে দেয়। এসময়টা চলে গেলে জীবনে হায় হায় করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। তাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ থাকল। প্রয়োজনে বড় ভাই, পিতামাতা, শিক্ষক, গুরুজন বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। একটা কথা আছে, সময় গেলে সাধন হবে না। ইংরেজিতেও একটা প্রবাদ আছে, “A stitch in time saves nine”। অর্থাৎ সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। তাই যারা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ চিন্তা করে দেখ এখনও সময় আছে। সময় শেষ হয়ে যায়নি। সবাই ভাল থেকো, সুস্থ থেকো। শুভ কামনা।
(এ লেখাটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ভাবনা ও অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে লেখা। লেখাটি আপনার ভাবনার সাথে নাও মিলতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার যেটা ভাল মনে হয় আপনি সেটা করতে পারেন। তবে এ লেখাটি পড়ে যদি কেউ একজনও উপকৃত হয় সেটাই আমার লেখার সার্থকতা।)
লেখক: দেবাশিস মণ্ডল, শিক্ষক