বিশেষ প্রতিবেদন: বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রিপেইড মিটার নিয়ে নানামুখী ভোগান্তির অভিযোগ করছেন গ্রাহকেরা। হঠাৎ কার্ডের টাকা শেষ হলে ছুটির দিনে রিচার্জ করা যায় না। কার্ড রিচার্জ করলে শুরুতেই অনেক টাকা কেনে নেওয়া হয়। একই বাড়িতে প্রিপেইড এবং পোস্টপেইড— দুই ধরনের মিটার থাকায় দুই পদ্ধতিতেই বিল দিতে হচ্ছে। আবার মিটারের মূল্য হিসেবে অনির্দষ্ট কাল মূল্য কেটে নেয়া হচ্ছে বলেও গ্রাহকদের অভিযোগ। আর এসব অভিযোগ নিয়ে আগামী শুক্রবার ২১ জুন সাতক্ষীরায় ‘নাগরিক গণশুনানী’র আয়োজন করেছে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা।
এমন নানা ধরনের ভোগান্তির অভিযোগ উঠলেও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, সমস্যা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। তারা নানাভাবে গ্রাহককে সেবা দিতে চেষ্টা করছেন। তবে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের নিয়ম পুরোটা না জানায় কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে তারা স্বীকার করেন। সারাদেশে বিদ্যুৎ বিতরণে প্রিপেইড মিটার বসাচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। আগামী ৫ বছরের মধ্যে সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে ধীরগতি হওয়ায় এর কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সারাদেশে ৩ কোটির বেশি বিদ্যুৎ গ্রাহক রয়েছে। তবে প্রিপেইড মিটার নেই ৫০ লাখ গ্রাহকের ঘরেও। প্রত্যেকটি বিতরণ কোম্পানি পৃথকভাবে প্রিপেইড মিটার স্থাপন করছে। তবে একই বাড়িতে দুই ধরনের মিটার এখনও রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা বলছে, মিটার সংকটের কারণে তারা নতুনদের প্রিপেইড মিটার দিতে পারছেন না। জনৈক গ্রাহক নিয়াজ আমহেদ বলেন, ‘শুরু থেকেই প্রিপেইড মিটার বিল দিতে গিয়ে ভোগান্তি হচ্ছে। প্রিপেইড মিটারে বাড়তি অর্থ কাটার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এক হাজার টাকা ঢোকালে শুরুতেই ২০০ টাকার মতো কেটে নিচ্ছে।’ এটাকে অত্যধিক বলে মনে করেন তিনি। গ্রাহকদের রয়েছে দুই রকম বক্তব্য। একজন গ্রাহক সাদিয়া সিরাজ জানান, প্রিপ্রেইড মিটার ব্যবহার করে তার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। তবে আরেক গ্রাহক রোকসানা মারজিয়া জানান, আগের তুলনায় বিল বেশি আসছে। আগে বিল আসতো ১৩০০-১৪০০ টাকা। এখন আসছে ২০০০-২১০০ টাকার মতো। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো অবশ্য বলছে, তারা কোন সমস্যা দেখছেন না। এদিকে খুলনায় প্রি-পেইড মিটারের ভোগান্তি ও ওজোপাডিকোরনিানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে নাগরিকরা। সংবাদ সস্মেলনে নাগরিকর নেতাদের দেয়া লিখিত বক্তব্য নিম্নরূপ-
পদ্মার এপারে ২১ জেলা নিয়ে গঠিত ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো)বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ থেকে এ কোম্পানির প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভ্যন্তরে যে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে, তার প্রতিবাদে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ভুক্তভোগী নাগরিকদের পক্ষ হতে বিএমএ ভবনে প্রতিবাদী সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিম্নে ওজোপাডিকো-র দুর্নীতির খতিয়ান সাংবাদিকদের সম্মুখে উপস্থাপিত হল।
১. বিনা মূল্যে প্রিপেইড মিটার দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে সিঙ্গেল ফেজ মিটারে ৪০ টাকা, থ্রি ফেজ মিটারের জন্য ২৫০ টাকা প্রতি মাসে কেটে নিচ্ছে ওজোপাডিকো । প্রশ্ন ওঠে, পূর্বের ডিজিটাল মিটারের টাকা অপরিশোধিত রেখে প্রিপেইড মিটারের বিলের সাথে ভাড়ার টাকা কর্তন (অনন্তকাল ধরে)- কত বড় দুর্নীতি ও হঠকারিতা তা আপনাদের বিবেচনার জন্য ছেড়ে দিলাম।
২. বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারের পূর্বে বিল পরিশোধ করার কারণে গ্রাহকরা ১% রিবেট পাবেন। গত ২০১৬ সাল থেকে প্রিপেইড মিটার চালু থাকলেও এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত গ্রাহকদের কোন প্রকার রিবেট দেওয়া হয়নি । আপনারা হিসাব মিলাতে পারবেন, গত আড়াই বছরে দেড় লক্ষ গ্রাহকদের কাছ থেকে ১% হারে রিবেটের কত টাকা ওজোপাডিকো আত্মসাৎ করেছে । গত ১৮ এপ্রিল ২০১৯ দৈনিক পূর্বাঞ্চল পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার হওয়ায় ৩০ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ১% রিবেট দিতে শুরু করেছে ওজোপাডিকো কর্তৃপক্ষ। আপনাদের মাধ্যমে বিগত সময়ে গ্রাহকদের বিপুল অংকের রিবেট আত্মসাৎ করা টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
৩. প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করার সাথে সাথে রিচার্জ এর টাকা ও বিভিন্ন খাতে কেটে নেওয়া টাকার মধ্যেও ব্যাপক গড়মিল রয়েছে । ওজোপাডিকোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এতটাই বেপরোয়া যে, গ্রাহকরা এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা চাইলে তারা উত্তেজিত হয় এবং অনীহা প্রকাশ করে। গ্রাহকরা সন্দেহ প্রকাশ করে যে, ওজোপাডিকোর ব্যবহৃত সফটওয়্যার এমন ভাবে তৈরি যা গ্রাহকের রিচার্জের টাকা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে ত্রুটিযুক্ত ও দুর্নীতিগ্রস্থ। সাংবাদিক বন্ধুদের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা আনার অনুরোধ জানাচ্ছি।
৪. মিটার লাগানোর সাথে সাথে প্রথম রিচার্জে সঠিক বিল আসলেও পরবর্তী মাস থেকে শুরু হয় অধিক বিলের ভোগান্তি, এই সবই সফটওয়্যার কারসাজি।
৫. প্রত্যেক গ্রাহকের বিল থেকে ভ্যাট কেটে নেওয়া হচ্ছে ৫%, কিন্তু গ্রাহকদের কোন কর চালানপত্র দেওয়া হয় না। যেখন ভ্যাট চালানপত্র সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসে জমা দিতে হয় সেখানে এভাবে ভ্যাট কেটে নেওয়ার কোন বিধান নাই ।
৬. প্রিপেইড মিটারে গ্রাহকদের প্রতি সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ হল মিটার লকিং ও লক ওপেনিং পদ্ধতি । নতুন ধরণের পদ্ধতিতে কোন ধরনের ট্রেনিং ছাড়া প্রিপেইড মিটার অপারেট করতে গিয়ে গ্রাহকদের মিটার অনিচ্ছাকৃত ভাবে লক হয়ে যাচ্ছে, যা খুলতে বন্ধ ব্যতীত কর্মদিবসে ওজোপাডিকো এর দ্বারস্থ হতে হয় এবং সাথে দিতে হয় অর্থদণ্ড। দণ্ডও নেহায়েত কম নয় । প্রতিবারে বার শত টাকার মাসুল গুনে খুলতে হয় লক । যদি কোন কারণে ছুটির দিন লক হয়ে যায়, তবে গ্রাহককে বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হয় ওজোপাডিকোর কর্মদিবসের অপেক্ষায় ।
৭. বিভিন্ন সময় মিটার বাইপাস এর ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রাহকদের হয়রানী ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইসলাম নগর এলাকার কয়েকজন গ্রাহকের বাড়ীতে ওজোপাডিকোর এরূপ কার্যক্রমের অভিযোগ উঠেছে।এটি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন, আপনাদের মাধ্যমে এ হয়রানী বন্ধের অভিযোগ জানাচ্ছি।
৮. গ্রাহক হয়রানীর আরেক সংযোজন হল ‘নো ট্রেজ বিল’ । পিডিবি আমলের এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ের পরিশোধিত বিলের স্লিপ না দেখাতে পারলে গ্রাহক ভৌতিক বিল পরিশোধে বাধ্য হচ্ছে । দীর্ঘ দিন ( ১০-১৫ বছর পর্যন্ত ) পূর্বের দাবীকৃত বকেয়া বিল সম্পর্কে গ্রাহকদের কাছে কোন নোটিশ জারি না করে হঠাৎ অভিযান করে বিপুল অংকের টাকা আদায় করছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে। এটি বন্ধ করার জন্য আপনাদের মাধ্যমে কোম্পানির প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
৯. প্রি পেইড মিটার ও কার্ড যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সঠিকতা নিরূপণের সনদ প্রাপ্ত নয়, যেমন পণ্যের সঠিকতা নিরূপণের ক্ষেত্রে গুনগত বিষয় পরীক্ষা করে বিএসটিআই সনদ প্রদান করে। কিন্তু গ্রাহকরা সঠিক প্রিপেইড মিটার ও কার্ড প্রাপ্তির দাবীদার । এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ওজোপাডিকো -র প্রতি আপনাদের মাধ্যমে আহ্বান জানাচ্ছি ।
১০. নতুন মিটার স্থাপনের ডিমান্ড নোটে সংযোগের বিবিধ উপকরণ ব্যয় ৫৯৮০ টাকা এবং ১৫% ভ্যাট ৮৯৭ টাকা সংযোজন করা হয়েছে । কোন উপকরণ সরবারহ না করে ডিমান্ড নোটের শেষাংশে শুধুমাত্র ৫,৯৮০ টাকা বিয়োজন করা হয় কিন্তু ভ্যাটের সংযোজন অব্যাহত থাকে। গ্রাহক হিসাবে প্রশ্ন – উপকরণ ব্যয়ের ভ্যাট ৮৯৭ টাকা কোথায় যায় ? অন্য একটা অংশে দেখা যায় মোট মালামালের ১০% ষ্টোর চার্জ মূল্যে ৬৩৩ টাকা যা ভ্যাট সহ ৭২৭.৯৫ টাকা। যেখানে কোন সরঞ্জামই প্রদান করা হল না সেখান আবার ষ্টোর চার্জ কি ? আমরা নির্লজ্জ এই দুর্নীতির ঘৃণ্য প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এই অনিয়ম বন্ধ করার জন্য আপনাদের মাধ্যমে কোম্পানির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ।
১১. প্রিপেইড মিটার অধ্যায়ের প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও নতুন সংযোগ এর ক্ষেত্রে চাপান হচ্ছে ডিজিটাল মিটার, যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রূপান্তরিত হবে প্রিপেইড মিটারে । তাহলে এই ১২০০-১৫০০ টাকার ডিজিটাল মিটার বিক্রির ফন্দি কার স্বার্থে, যে পাঠার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের । এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ওজোপাডিকো এর প্রতি আপনাদের মাধ্যমে আহ্বান জানাচ্ছি।
১২. প্রিপেইড মিটার ছাড়াও ওজোপাডিকো এর অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য অনিয়ম দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানির চিত্র। দুদক বা সরকারী উপযুক্ত সংস্থা দিয়ে তদন্ত করলেই অনেক অনিয়ম বেরিয়ে আসবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিধি ভঙ্গ করে অধিকাংশ সময় কর্মস্থলের বাহিরে ( ঢাকায় ) অবস্থান করেন । প্রতিষ্ঠানের টাকায় কর্মকর্তাদের কারণে অকারণে বিদেশ গমনের ফলে রাষ্ট্রের বিপুল অংকের টাকা অপচয় হচ্ছে । এক কথায় ওজোপাডিকো-তে গ্রাহকের টাকায় চলছে হরিলুট।