দেশের খবর: বরগুনা সদর থানার রিফাত শরীফ। স্ত্রীর সামনে তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার ভিডিওচিত্র ভাইরাল হওয়ার পর কেঁপে উঠেছে সাধারণ মানুষের বিবেক। এ হত্যাকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ঘাতক সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড দীর্ঘদিন ধরে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। রিফাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে বড় ধরনের ক্ষতির হুমকিও দেয় সে। বুধবার রিফাতকে হত্যার আগেও তাকে নানাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল সে।
দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত নয়ন। থানা পুলিশের সখ্য কাজে লাগিয়ে তাদের ম্যানেজ করে সাজানো মামলায় রিফাতকে জেলও খাটায় সে। ১০ গ্রাম গাঁজার মামলায় কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে আসেন রিফাত। এরপর অন্তত ১২ সহযোগী নিয়ে রিফাতকে হত্যার ছক কষে নয়ন।
কীভাবে ছেলেকে গাঁজা বহনের মামলায় ফাঁসানো হলো- সেই করুণ কাহিনী বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। তিনি জানান, রোজার ঈদের আগে এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি বরগুনা সদর থানায় হাজির হন। কারণ, এলাকার এক নিরপরাধ ছেলেকে সাজানো মাদকের মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছিলেন স্থানীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। পরে এলাকাবাসীর চাপে ছেলেটি মামলা থেকে রেহাই পায়। রাতে থানায় স্থানীয়দের জটলা চলার সময়েই আবদুল হালিমের ছেলেকে গাঁজাসহ গ্রেফতারের খবর ওসির কাছে আসে। ওসি খবর নিয়ে জানতে পারেন, থানার এসআই ওবায়দুর, আসাদ ও এএসআই সোহেল সদর থানার একটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে রিফাত ও ইলিয়াস নামের দু’জনকে আটক করেছে। তাদের একজনের কাছে ১০ গ্রাম ও আরেকজনের কাছে পাঁচ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার দাবি করে অপারেশনে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যরা।
রিফাতের বাবা জানান, ছেলে গাঁজাসহ গ্রেফতার হয়েছে- এটা জানার পর আসলে সেখানে কী ঘটেছিল, তার খোঁজ করেন তিনি। পরে জানতে পারেন, জরুরি একটি কাজ আছে বলে নয়নের এক বন্ধু বাসা থেকে রিফাতকে ডেকে নেয়। যে ডেকে নিয়েছিল, সে রিফাতেরও পূর্বপরিচিত। তারা দু’জন মোটরসাইকেলে বরগুনা সদর থানার চৌমহনী এলাকায় পৌঁছালে আগে থেকে সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের মোটরসাইকেল থামানোর নির্দেশ দেয়। এরপর তাদের শরীর তল্লাশি করে দুই প্যাকেট গাঁজা থাকার দাবি করে পুলিশ সদস্যরা। পরিকল্পিত এই অভিযানের ভিডিও করছিল ঘটনাস্থলে পুলিশের সঙ্গে থাকা নয়ন বন্ড। সে পুলিশের সোর্স হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল। তার বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা ও অভিযোগ রয়েছে।
নয়ন রাতেই স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মীকে ফোন করে জানায়, রিফাতের কাছে কয়েক হাজার পিস ইয়াবা বড়ি পাওয়া গেছে। তারা যেন এ সংবাদ পরিবেশন করেন। তবে সংবাদকর্মীদের কয়েকজন রিফাতের বাবাকে রাতেই ফোন করে জানান, রিফাতের কাছে ইয়াবা পাওয়ার এ খবর তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তাই তারা ওই খবর প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।
আবদুল হালিমের ভাষ্য, থানায় বসেই ওসিকে তিনি জানান, তার ছেলেকে ডেকে নিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তখন ওসি বলেন, যেহেতু বিষয়টি সাংবাদিকরা জেনে গেছেন, তাই রিফাতকে তাৎক্ষণিকভাবে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। পরে ঈদুল ফিতরের তিন/চার দিন আগে কারাগার থেকে জামিনে বের হয় তার ছেলে।
আবদুল হালিম বলেন, ছেলে মরে গেছে, এখন আর তার সম্পর্কে কী বলব। শুধু এটুকু বলতে পারি, রিফাত কোনোভাবেই মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিল না। বছর খানেকের বেশি সময় আয়েশার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার ছেলের। এরপর পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়।
কেন নয়ন বন্ড রিফাতকে ফাঁসাবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে আবদুল হালিম বললেন, বেশ কয়েক দফা নয়নের বাসায় অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। পরে আবার পুলিশের সঙ্গে নয়নের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। যদিও তার বিরুদ্ধে মাদক বিক্রি, ছিনতাইসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। নয়নের ধারণা ছিল, হয়তো তার কুকীর্তির ব্যাপারে পুলিশকে তথ্য দিয়ে চলেছে রিফাত। এ ছাড়া আয়েশাকে সে বিয়ে করেছে- এ ক্ষোভও তার থাকতে পারে।
রিফাতের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী হাসানুর রহমান জন বলেন, এ মামলার তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, রিফাতকে আসলে গাঁজা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছিল। কিছুদিন কারাভোগের পর রিফাত জামিনে ছিলেন। এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে তার আগেই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে গেল।
আয়েশার মা জিনাত জাহান সমকালকে জানান, বিয়ের পর মেয়েকে এখনও শ্বশুরবাড়ি তুলে দেননি। মেয়ের জামাই প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন। প্রায় নিয়মিত তার মেয়েকে বরগুনা কলেজে আনা-নেওয়া করতেন রিফাত। বাঁচানোর চেষ্টা করেও আয়েশা তার স্বামীর জীবন রক্ষা করতে পারেননি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মাহমুদ হোসেন বলেন, গাঁজা নিয়ে রিফাতসহ দু’জনকে ধরা হয়েছিল। ঘটনাস্থলে নয়ন বন্ড উপস্থিত ছিল না। সাত মাস ধরে এই থানায় রয়েছি। নয়ন বন্ড থানার সোর্স, এটা জানা নেই।
নিহতের পরিবারের ভাষ্য, রিফাতকে ফাঁসানো হয়েছে- এ ব্যাপারে ওসির ভাষ্য, যারা মাদকবিরোধী ওই অপারেশনে ছিল, তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
এখন পর্যন্ত রিফাত হত্যায় ১২ জনের সংশ্নিষ্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে সেখানে এমন ‘নাটকীয়’ কিছু দৃশ্য পাওয়া গেছে, যা পরে তদন্তের মোড় ঘোরাতে পারে।