দেশের খবর: বহুল আলোচিত ২৬ মামলার আসামি টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক জাহালমকে আসামি করার পেছনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন মহাপরিচালক (ডিজি), একজন পরিচালক ও ১২ জন তদন্ত কর্মকর্তা অর্থাৎ ১৪ কর্মকর্তার অবহেলাকে দায়ী করেছে দুদকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও দায়ী করা হয়েছে। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল বৃহস্পতিবার ওই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
প্রতিবেদন দাখিলের সময় আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। জাহালমের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট অমিত দাসগুপ্ত। ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান। আগামী ১৬ জুলাই এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় প্রতীয়মান হয় যে জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে কাজটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের কারণেই হয়েছে। আর তাঁদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছেন ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং অ্যাকাউন্টসের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা।
টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক জাহালমকে আসামি করার সঙ্গে দুদকের কেউ জড়িত ছিল কি না, তা চিহ্নিত করতে দুদক অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটির প্রধান করা হয় আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদকে। তিনি ২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দেন, যা গতকাল হাইকোর্টে দাখিল করা হয়।
প্রতিবেদনে তৎকালীন সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি, সুমিত্রা সেন, ফয়সাল মাহমুদ, উপসহকারী পরিচালক নাজমুচ্ছায়াদাত, মো. জাকারিয়া, এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন, সিলভিয়া ফেরদৌস, মো. আল আমিন, মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন, রাফী মো. নাজমুস সা’দাত, শংকর কুমার চক্রবর্তী ছাড়াও ৩৩ মামলার বাদী, প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ও তদারককারী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, পরবর্তী তদারককারী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুক ও সাবেক মহাপরিচালক হানিফ ইকবালের অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইওরা সিরিয়াস ও সঠিকভাবে মামলার তদন্ত করেননি। প্রত্যেকেই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রত্যেকেই আশায় ছিলেন অন্যরা তদন্তে অগ্রগতি করলে তাঁরা সেটি কপি করবেন এবং সেটিই তাঁরা করেছেন। এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম সেলিনা আক্তার মনি। শুধু তিনিই আবু সালেককে শনাক্ত করা বা খুঁজে বের করার জন্য তৎপর ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলার আইওরা ও তদারককারী আরো যত্নবান হলে বা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসরণ করলে এই মারাত্মক ভুল হতো না। তাঁদের এই ভুল সরল বিশ্বাসে, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে, তা সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয়। এটি শুধু আদালত নির্ধারণ করতে পারেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আবু সালেকসহ অন্যদের ধরিয়ে দিতে ছবি দিয়ে পত্রিকা বা টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া যেত, তা দেওয়া হয়নি। জাহালমের সঙ্গে মামলার অন্য আসামিদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। প্রতিবেদনে আরো যেসব ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে অন্যতম জাহালমের সামাজিক ও আর্থিক সংগতি বিবেচনায় না নেওয়া, ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে নিরূপণ না করা, আত্মসাৎ করা টাকার গন্তব্যের পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ না করা, আইন অনুযায়ী ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত না করা। মামলাগুলোতে ১২ তদন্ত কর্মকর্তার মধ্যে কেউই জাহালমের বাড়ি পরিদর্শন করেননি। করলে জাহালমের বাড়ির দৈন্যদশা দেখে তদন্ত কর্মকর্তাদের মনে অবশ্যই সন্দেহ দেখা দিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদ্ঘাটন করে আদালতের কাছে তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর বা অন্য কারো ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এটি লক্ষ করা উচিত ছিল যে প্রথমে কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা কিংবা অ্যাকাউন্টসের শনাক্তকারীরা আবু সালেককে শনাক্ত করতে কিংবা তাঁকে খুঁজে বের করতে তৎপর হননি।
তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ : প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে আছে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা (অনুসন্ধান তদারকি প্যানেল) করা। ট্রেইল দ্য মানি (কোনো দুর্নীতির অপরাধ সংঘটনের পর ওই ঘটনার প্রকৃত সুবিধাভোগী নির্ধারণ এবং আইনের আওতায় আনার জন্য) প্রতিষ্ঠা করা। অপরাধলব্ধ অর্থ বা সম্পদের গতিবিধি অনুসরণ করে মূল অপরাধী শনাক্ত করার লক্ষ্যে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা। সাক্ষী ও আসামিদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই করা। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করা যেতে পারে। অনুসন্ধান নোট বই ও কেস ডায়েরি যথাযথভাবে লেখা ও সংরক্ষণ করা। গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের রিমান্ডে এনে ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের ব্যবস্থা করা। একই ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের না করা।
“৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে” শিরোনামে জাহালমের প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকার বিষয়টি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন। আদালত কারাগারে থাকা জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশে গত ৩ ফেব্রুয়ারি জাহালমকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে শুনানি চলছে।