দেশের খবর: বরগুনায় রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার আসামি নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে যেমন মাদকের কয়েকটি মামলা রয়েছে, তেমনি মাদকের একাধিক মামলার আসামি নিহত রিফাত শরীফও। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নয়ন বন্ড, রিফাত শরীফ, রিফাত ফরাজী
– এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু ছিলেন, কিন্তু মাদক নিয়ে বিরোধেই তারা আবার শত্রুতে পরিণত হন।
বরগুনার ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, “মাদক নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরেই রিফাতকে মাদক দিয়ে নয়ন ফাঁসিয়েছিল। মাদক সম্পৃক্ততার দায়ে রিফাতও জেলে ছিল। পুরো ঘটনা সবার জানা।”
গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য সড়কে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচিত এখন।
রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার সময় তা ঠেকাতে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির চেষ্টার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আলোচনার ঝড় বয়ে যায়; কিন্তু এখন স্বামীর হত্যাকাণ্ডে মিন্নি নিজেই গ্রেপ্তার হয়ে আছেন।
মিন্নিকে নিয়ে সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) ও রিফাত শরীফের দ্বন্দ্ব এই হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে পুলিশ দাবি করলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মাদকের বিষয়টি।
বরগুনা থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন জানান, রিফাত শরীফ হত্যার প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের নামে আটটি ও রিফাত ফরাজীর নামে চারটি মামলা রয়েছে। এর অধিকাংশই মাদকের মামলা। থানায় খবর নিয়ে জানা যায়, রিফাত শরীফের নামেও মাদকের দুটি মামলা রয়েছে। একটিতে তার সঙ্গে রিফাত ফরাজীও আসামি। গত ১১ মে রাতে ১০০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে ১৯ দিন হাজত খেটে বেরিয়ে এসেছিলেন রিফাত শরীফ।
তার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে খুন হন তিনি। হামলার ভিডিওতে তাকে কোপাতে দেখা গিয়েছিল নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীকে। আর রিফাতের ভাই রিশান ফরাজীসহ আরও বেশ কয়েকজন তরুণও ছিলেন এই হামলায়।
স্থানীয়রা জানান, নয়নসহ অন্যরা সিনেমার নায়ক জেমস বন্ডের নামে ‘বন্ড ০০৭’ নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপ গড়ে এলাকায় মাদক সেবন-বিক্রি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই চালিয়ে যাচ্ছিল।
রিফাত শরীফ, রিফাত ফরাজী, নয়নকে একত্রেই চলাফেরা করতে দেখেছেন এলাকার মানুষ। তবে কয়েক মাস আগে রিফাত শরীফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে অন্যদের বিরোধ দেখা দেয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার দুই ছেলে রিফাত ও রিশান ছাত্রলীগের নানা কর্মসূচিতে থাকতেন।
অন্যদিকে নয়ন এক সময় ছাত্রদলে থাকলেও পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নি এর আগে নয়নকে বিয়ে করেছিলেন বলেও স্থানীয়দের ভাষ্য; যদিও মিন্নি তা অস্বীকার করে দাবি করে আসছেন, নয়ন জোর করে তার কাছ থেকে একটি কাগজে সই নিয়েছিলেন।
রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের পর বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেছিলেন, মিন্নিকে নিজের স্ত্রী দাবি করছিলেন নয়ন, দুই মাস আগে মিন্নি রিফাত শরীফকে বিয়ে করলে দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনও ‘মিন্নিকে নিয়ে বিরোধের’ কথা বলে এলেও খুনের নেপথ্যে মাদক চক্রের বিরোধের বিষয়টির পক্ষে প্রমাণ হয়ে আসছে ঘটনার সময়কার একটি ভিডিও। কলেজ ফটকের সিসি ক্যামেরার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, রিফাত শরীফকে ধরে নেওয়া থেকে শুরু করে হামলা এবং রামদা আনার পুরো প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বে ছিলেন রিফাত ফরাজী।
মিন্নির কারণেই যদি রিফাত শরীফকে খুন করেন নয়ন, তবে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীর অতি তৎপরতা কেন?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, কয়েকদিন আগেই রিফাত শরীফ তার সঙ্গীদের নিয়ে পিটিয়েছিলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আত্মীয় রিফাত ফরাজীকে। আর রিফাত ফরাজীকে পেটানোর ঘটনাটির পেছনে আবার রয়েছে দুই মাস আগে রিফাত শরীফের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা।
১১ মে রাত পৌনে ২টার দিকে রিফাত শরীফকে মাদকসহ গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন বরগুনা থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক সোহেল খান। ওই মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে। রিফাত শরীফকে আটকের দৃশ্য আবার ছড়িয়ে পড়েছিল ফেইসবুকে, যার জন্য নয়নকে দায়ী করছিলেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, কারাগার থেকে বেরিয়ে জুন মাসের শুরুতে রিফাত শরীফ তার সহযোগীদের নিয়ে রিফাত ফরাজীকে হাতুড়ি পেটা করেন। যাতে ক্ষিপ্ত ছিলেন দুই ফরাজী ভাই।
তবে রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ ছেলের মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। তিনি বলছেন, রিফাত শরীফকে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়েছিলেন নয়ন বন্ড।
রিফাতের সঙ্গে নয়নের সাম্প্রতিক বিরোধের পেছনেও যে মাদক রয়েছে, সে কথা উঠে এসেছে মিন্নির চাচা আবু সালেহর কথায়।
তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে রিফাত শরীফের কাছ থেকে ইয়াবা কিনেছিল হেলাল নামে এক যুবক। সেই টাকা না দেওয়ায় গত ২৪ জুন (খুনের দুদিন আগে) হেলালের মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নেয় রিফাত শরীফ।”
হেলাল সেই মোবাইল ফোন উদ্ধারে নয়ন বন্ডের দ্বারস্ত হয়েছিলেন, নয়ন তখন ওই মোবাইল ফোনসেটটি উদ্ধার করে দিতে মিন্নিকে বলেন বলে জানান আবু সালেহ।
হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির যে সাক্ষাতের কথা এই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলে আসছেন, সেটাও ওই ফোন নিয়ে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ওই মোবাইল উদ্ধার করতে গিয়ে স্বামীর মার খেতে হয় মিন্নিকে। সে সেটা নয়ন বন্ডকে বলেছিল। তখন নয়ন বলে যে এজন্য রিফাতকে শিক্ষা দেওয়া হবে।” এরপর রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি ফেইসবুক মেসেঞ্জারে বন্ড 007 নামে গ্রুপের কথোপকথনে উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, রিফাত ফরাজী রামদা নিয়ে পরদিন কলেজের সামনে আসতে বলেন গ্রুপের আরেকজনকে।
‘বন্ড’র মতো আরও কিছু তরুণ ও কিশোর বাহিনীর দৌরাত্ম্য কিছু কাল ধরেই দেখতে হচ্ছে বরগুনা শহরবাসীকে। এর মধ্যে রয়েছে ‘টিম ৬১’, ‘লারেলাপ্পা’, ‘হানীবন্ড’ ইত্যাদি। এসব গ্রুপের সদস্যদের একতা মাদক সেবনে, মোটর সাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় তারা।
বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আনিসুর রহমান বলেন, রিফাত শরীফ হত্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘মাদক ও কিশোর গ্যাং বাহিনী’।
তিনি বলেন, “তিনটি পরীক্ষায় পাস করে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হতে হয়। প্রথমত, মাদকসেবী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, মাদক ব্যবসায় যুক্ত হতে হবে। তৃতীয়ত, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লুটপাটে ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করতে হবে।”
এই বাহিনীর অনেকের দামি মোটর সাইকেলে ঘুরে বেড়ানো, ৫০/৬০ হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরে এই অর্থের উৎস হিসেবে মাদক কেনা-বেচাকেই দেখান আনিসুর।
মানবাধিকারকর্মী হাসানুর রহমান বলেন, বরগুনা জেলা শহরের প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মাদক গ্যাং’ রয়েছে, এরা শিক্ষার্থীদের মাদকসেবী বানাচ্ছে। বরগুনার এই মাদক চক্র এমপিপুত্র সুনামের মদদ পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক। এসব ‘গ্যাং’ সুনামের সৃষ্টি বলেও তার অভিযোগ।
রিফাত খুনের পর পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয়ন বন্ডের মা শাহিদা বেগম জানিয়েছেন, এমপিপুত্র সুনামের সাথে তার ছেলের এক সময় ‘ভালো’ সম্পর্ক ছিল। তবে গত উপজেলা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে একটু ফাটল ধরে।
সুনাম দেবনাথ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার বাবা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু যাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পান সেজন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তার বাবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে তার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর বরগুনায় মাদকচক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর দাবি জোরেশোরে উঠেছে। মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আরও হত্যাকাণ্ড ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বরগুনা জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি নাজমা বেগম।