মীর খায়রুল আলম: আর মাত্র কয়েকদিন পর পবিত্র ঈদুল আযহা। আর এ ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় কাটানোর কথা থাকলেও দেবহাটা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারের কামারদের কর্মব্যস্ততা নেই বললেও চলে। আগের দিনগুলোতে দা, কুড়াল, বঁটি, চাকু, কোঁদালসহ লোহার যন্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করলেও আজকের দিনে তা অনেক অংশে কমেছে। দিনের শেষে রাতেও বিরাম ছিল না এসব কারিগরদের। সবসময় শুন-শান আর ট্যুং-ট্যাং শব্দে মুখরিত থাকতো কামারশালাগুলো। বিশেষ করে কামারদের এই ব্যস্ততা জানান দেয় ঈদুল আযহা অতি সন্নিকটে আসলে। মঙ্গলবার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কেউ হাতুড়ি দিয়ে লোহা পেটাচ্ছে, কেউ হপার টানছে, কেউবা আবার তৈরী করা সামগ্রীতে শান (ধার) দিচ্ছে। কোরবানীর পশুর চামড়া ছাড়ানো থেকে শুরু করে গোস্ত কাটার কাজে ব্যবহার করা হয় কামারশালার বিভিন্ন শৈল্পিক সামগ্রী। উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারের কামার পল্লীর কারিগরদের তেমন ব্যস্ততা নেই। অধিকাংশ দোকানেই কিছু সংখ্যক যন্ত্রপাতি তৈরী করা হচ্ছে। কামারদের হাতে তৈরী করা এসব দা, বটি, চাকু, কুড়াল কিনতেও ক্রেতাদের আগের মত দেখা যায় না। কেননা নতুন চাকু তৈরী করতে ৫০-৬০ টাকা, দা ও বটি দুশত থেকে ৪৫০ টাকা, কাচি ৫০-৬০ টাকা, ফোড় (ঘাসমারা যন্ত্র) ২৫-৩০ টাকা, কোপা ৪শত থেকে সাড়ে ৪শত টাকা কেজি, লাফনা(মাটিকাটা যন্ত্র )দেড়শত থেকে ২শত টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। অপরদিকে, শান দেওয়া বটি ৪০ টাকা, কাচি ২০ টাকা, দা ৪০ টাকা, কোপা ৮০ টাকা, চাকু ১৫ টাকা হওয়ায় শানের পরিবর্তে হাতে তৈরী করা যন্ত্রের পরিবর্তে আধুনিকে ঝুঁকে পড়ছেন ক্রেতারা। কিন্তু আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে অনেক কম টাকায় এসব যন্ত্রপাতি পাওয়া যাচ্ছে সে কারনে অনেকেই কামারদের কাছে যান না। তবে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীও রয়েছে, য শুধু ঈদের সময়ই এ ব্যবসাটি একটু বেশি হয়ে থাকে। অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবছর ঈদুল আযহার সময় তেমন কর্মব্যস্ততা বাড়েনি বলে জানান অনেকে। কামটা কামার পল্লীর রবিন কর্মকার বলেন, পূর্বপুরুষের পেশা হিসেবে বর্তমান এ পেশায় কর্মরত আছেন। আগের দিনগুলোতে প্রতিদিন হাজার টাকা মত আয় হত। কিন্তু বর্তমানে গড়ে ৪শত টাকা হারে আয় হয়। তবে আমাদের মূল টার্গেট থাকে কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র্র করে। বিগত বছরের তুলনায় এবার ঈদে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানান তিনি। অপর কর্মকার রাধাপদ বলেন, কোরবানিকে কেন্দ্র করে কিছুটা অর্ডার আসতে শুরু করেছে। তবে, কাজের চাপ খুববেশি না থাকলেও কয়লার সমস্যার কারণে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। কাজ এগোচ্ছে না। যন্ত্র তৈরীর জ্বালানি কয়লার দামও বাড়ছে। গত ঈদে এক বস্তা কয়লার দাম ছিল ৫০০ টাকা আর এবার তা আমাদের কিনতে হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। তাছাড়া দিন-রাত সারাক্ষণ আগুনের পাশেই বসেই কাটাতে হয়। কামারেরা আরও জানান, এভাবে যদি লোহা ও কয়লার দাম বাড়তেই থাকে তাহলে এ পেশাকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে। এই পেশা ছাড়ছি না কেননা বাপদাদা পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। একাজ ছাড়া অন্য কাজ শিখিনি। তাই এই পেশা ছাড়ার উপায় নেই। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তই হতে যাচ্ছে। আশির দশকেও গ্রামগঞ্জের যেখানে সেখানে কামারশালা দেখা যেত। কিন্তু এখন আর এগুলো সচারাচর চোখে পড়েনা। এর প্রধান কারণ, শারীরিক ক্ষতি, অধিক পারিশ্রমি, উপযুক্ত মজুরী না পাওয়া এবং সর্বপরি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে প্রতি বছর কোরবানীর ঈদ এলেই কিছুটা কদর বাড়ে কামারদের। এরপর থেকে বছরের অবশিষ্ট দিনগুলোতে অধিকাংশ কামারেরাই থাকেন প্রায় কর্মহীন। যেকারণে অভাব অনটনেই চলছে দরিদ্র কামারদের জীবন সংসার। হচ্ছেনা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন। ফলে অনেক কামারই তাদের এই আদিপেশা ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন বিকল্প পেশা। ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি বিলুপ্ত হওয়ার আগেই এর পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকই।