সাতক্ষীরা

সহিহ বাকী রাজাকার কাহিনি

By Daily Satkhira

March 19, 2017

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরার ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস খুনী এম আব্দুল্লাহিল বাকী সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের বুলারাটী গ্রামে ১৯১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র হিসেবে প্রচণ্ড মেধাবী হলেও তরুণ বয়স থেকেই হিংস্রতার জন্য কুখ্যাতি ছিল বাকীর।

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আসামি বাকি ১৯৬৪ সালে তৎকালীন সাতক্ষীরা মহকুমার আলিপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে দাপট ছিল বাকির। এভাবে টানা ২৪ বছর একই ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট অথবা চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৮ সালে সাতক্ষীরা মহকুমার ৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে গঠিত চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। এরপর কো-অপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন আবদুল্লাহেল বাকি।

আবদুল্লাহেল বাকির বাবা হাজি জমিরুদ্দিন। তাঁরা দুই ভাই ও দুই বোন। তাঁরা হলেন আবদুল্লাহেল বাকি, আহলে হাদীস নেতা ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব, জামিলা খাতুন ও হালিমা খাতুন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আবদুল্লাহেল বাকির দুই স্ত্রীর প্রথম জন টরি বেগম মারা গেছেন। এখন বেঁচে আছেন ছোট স্ত্রী সাজেদা খাতুন। তাঁর নয় মেয়ে ও তিন ছেলে এবং ৬৪ নাতি-নাতনি রয়েছেন। মেয়েরা হলেন লতিফা খাতুন, তৈয়বা খাতুন, হেনা খাতুন, মিনা খাতুন, আছিয়া খাতুন, সালমা খাতুন, তাহমিনা খাতুন ও মৌহসেনা খাতুন। অপর মেয়ে নাজমা খাতুন মারা গেছেন। বাকির তিন ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বেসিক ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মেজ ছেলে মোস্তাজারুর রহমান বাবুল সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অধ্যাপক এবং ছোট ছেলে মোস্তাফিরুর রহমান হাবুল একজন মুদি ব্যবসায়ী। আবদুল্লাহেল বাকি খুলনায় তাঁর বড় ছেলের বাসায় থাকতেন। পাঁচ দিন আগে তাঁকে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আলিপুর ইউনিয়নের বুলারাটিতে নিয়ে আসা হয়।

একাত্তরে আবদুল্লাহেল বাকির নাম শুনলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠত। সাতক্ষীরা সদর থানা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে সুলতানপুর বড়বাজারমুখী সড়কের পূর্ব পাশ ঘেঁষে ছিল রাজাকার বাকির টর্চারিং সেন্টার। বর্তমানে সেটি অগ্রণী ব্যাংক। এভারগ্রিন ট্রেডের দোতলায় এ ভবনটি ছিল ডায়মন্ড কোম্পানির স্টার হোটেল হিসেবে পরিচিত। এর পরিচালক ছিলেন অবাঙালি মুসা খান।

সাতক্ষীরার বিশিষ্ট কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরার ত্রাস আবদুল্লাহেল বাকি তাঁর দোসরদের নিয়ে ‘পাকিস্তানের শত্রু নিধন’-এর লক্ষ্যে গড়ে তোলেন এ টর্চার সেল। এখানে ধরে আনা কথিত কাফেরদের বেতলাঠি ও মুগুর দিয়ে আঘাত করা ছাড়াও ছুরি ও ব্লেড দিয়ে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চিরে লবণ দেওয়া হতো। গরম পানিতে চুবিয়ে ধরা হতো। ঝুলিয়ে মারা হতো বেত। কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে মজা দেখতেন বাকিসহ তাঁর সহযোগীরা। কয়েক দিনের নির্যাতনের পর কোনো স্বীকারোক্তি না পাওয়া গেলে বাঙালি সন্তানদের নিয়ে যাওয়া হতো পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। এরপর মাহমুদপুর অথবা বিনেরপোতায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো তাদের। টর্চার সেলে নেওয়া পুষ্পকাটী গ্রামের তরুণ ছাত্র আনসার আলীকে হত্যা করেন বাকী। আনসার হত্যার অভিযোগেও বাকীর বিচার চলছে।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বাকির টর্চার সেলের দুই ঘাতক কসাই ছিলেন শহরের নবজীবন এনজিওর খান রোকনুজ্জামান ও পলাশপোল হাইস্কুলের প্রয়াত শিক্ষক কবির আহমেদ। তাঁরা আনসারের লাশ নিয়ে পরিবারের হাতে পৌঁছে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার এটাই ফল। দেবহাটার ঘলঘলিয়ার তরুণ ছাত্র খলিলুর রহমানকে ডায়মন্ড টর্চার সেলে এক সপ্তাহ নির্যাতন চালিয়ে যশোর সেনাক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে খলিলুর রহমান পালিয়ে বাাঁচেন। সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মো. নজরুল ইসলামকে গাড়ির চাকায় বেঁধে টেনে আনা হয় বাকির টর্চার সেলে। কয়েক দিনের নিপীড়নের পর ঘাতকরা নজরুলকে বাঁকাল খালের ধারে ছুড়ে ফেলে দেয়। দুদিন পর সাতক্ষীরা থানার ওসি তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেও তিনি একই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একজন পাকিস্তানি সৈনিককে দেখে আতঙ্কে সরে পড়েন। বাকির নেতৃত্বে আলিপুরের মাহমুদপুরে ছিল আরো একটি কিলিং সেন্টার (হত্যার জায়গা)। শহরের স্টার ডায়মন্ড হোটেলে নির্যাতন করে কিছু উদ্ধারে ব্যর্থ হলে কথিত কাফেরদের পাঠানো হতো মাহমুদপুরে। সাড়ে চার দশক পর আজও এ অঞ্চলে কথিত আছে ‘কী ছিল কপালের ফের, যাব টাকি সোদপুর, গেলাম কিনা মাহমুদপুর’। মুক্তিযুদ্ধকালে সেখানে রোজ ২০ থেকে ৫০টি পর্যন্ত লাশ ফেলা হতো বলে এলাকাবাসী জানায়। ১৯৭১-এর ৩০ নভেম্বর আলিপুর পুষ্পকাটী এলাকায় কয়েকশ’মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। এ খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী খুলনা অভিমুখে পলায়ন শুরু করতেই আতঙ্কিত বাকি, খালেক, খান রোকনুজ্জামান, কবির আহমেদ ও জহুরুল ইসলামসহ অন্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পলায়ন করেন। তাঁদের মধ্যে রাজাকার খালেক ওরফে মওলানা আবদুল খালেক মণ্ডল যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আছেন। রাজাকার কবির আহমেদ মারা গেছেন। এ ছাড়া খান রোকনুজ্জামান ও জহুরুল ইসলামসহ অন্যরা এই মুহূর্তে পালিয়ে আছেন।