জাতীয়

চামড়ার দামে মহাবিপর্যয়; ক্ষতিগ্রস্ত দুস্থ ও এতিমরা

By Daily Satkhira

August 13, 2019

দেশের খবর: এবার কাঁচা চামড়ার দামে মহাবিপর্যয় হলেও চামড়া ব্যবসায়ীদের কোনও লোকসান হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ট্যানারি পর্যন্ত চামড়া পৌঁছাতে চার স্তরের হাতবদলের যে চক্রটি কাজ করে তাদের কেউ এবার লোকসানও দিচ্ছে না। তবে ভয়াবহভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে গরিব-মিসকিন ও এতিমরা।

ধর্মীয় রেওয়াজ অনুযায়ী, কাঁচা চামড়া বিক্রির টাকা কোরবানিদাতারা গরিব-মিসকিন ও এতিমদের মধ্যে দান করে থাকেন। কিন্তু, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়া জাতীয় পণ্যের বাজার চড়া থাকলেও এবছর সরকারিভাবে কাঁচা চামড়ার দাম গতবছরের দরেই নির্ধারিত হয়েছে। এরপর কাঁচা চামড়া কেনার পাইকার ও ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই ‘টাকা নেই’, ‘বেশি দামে চামড়া কিনলে বেচতে পারবেন না’, ‘সংরক্ষণ করার প্রস্তুতি রাখুন’, ‘চামড়া পচে যেতে পারে’ ইত্যাদি হুজুগ তোলায় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনেছেন প্রায় বিনামূল্যে। ফলে চামড়ার দাম একেবারেই পড়ে যাওয়ায় কোরবানিদাতার দানের টাকার পরিমাণ গেছে কমে। ফলে চামড়া ব্যবসায়ে জড়িত সবাই লাভবান হলেও বঞ্চিত হয়েছেন কেবল এতিম ও দুস্থরা। তাদের প্রাপ্য অংশ এবার ভয়াবহভাবে কমে গেছে।

এ প্রসঙ্গে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, এবার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছে। ফলে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সব স্তরের ব্যবসায়ীরাই এবার লাভ করতে পারবে বলে আশা করা যায়। তিনি উল্লেখ করেন, ফরিয়া বা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা গরুর মালিকের কাছ থেকে যে চামড়া এবার ২শ’ টাকায় কিনেছে, সেই চামড়া তারা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকায়। নিচের ধাপেই দাম কম থাকায় এর পরের স্তরের পাইকার, আড়তদার ও শেষে ট্যানারি মালিকরা সবাই হয়তো এবার মুনাফা করতে পারবে। তবে আমাদের হাতে এই মুহুর্তে সব চামড়া কেনার মতো টাকা নেই। যে কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবার সব চামড়া আমরা কিনতে পারছি না।

তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকরা সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রেখেছেন। অন্যান্য ঈদের সময় ১০ থেকে ২০ শতাংশ নগদ টাকা দিলেও এবার হাতেগোনা কয়েকজন টাকা পেয়েছেন। যারা টাকা পেয়েছেন তারা চামড়া কিনছেন। এবছর ২৪৫ জন আড়তদারের মধ্যে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন আড়তদার চামড়া কিনতে পারছেন বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, চামড়া বিক্রির টাকা গরিব, এতিম ও দুস্থদের হক বলে মনে করা হয়।

এ প্রসঙ্গে পাবনার মাওলানা নুর ইয়া-হিয়া হেলাল বলেন, চামড়া বিক্রির টাকা মূলত গরিব, এতিম ও দুস্থদের হক। কাজেই চামড়ার দাম কমে যাওয়া মানেই গরিব, এতিমদের অংশ কমে যাওয়া। তিনি বলেন, চার বছর আগে বড় একটি গরুর চামড়ার টাকা দিয়ে একজন এতিম ছয় মাস চলতে পারতো। কিন্তু এবার ওই ধরনের বড় গরুর চামড়ার টাকায় তার এক মাসও যাবে না।

মূলত যারা গরু, মহিষ, ছাগল বা হালাল পশু কোরবানি করেন, সেই পশুর চামড়া বিক্রির টাকা স্থানীয় মাদ্রাসার গরিব ছাত্র, এতিম-মিসকিন বা গরিব বা দুস্থদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়ে থাকেন। কিন্তু, কয়েক বছর হলো সেই চামড়ার দাম পাচ্ছেন না পশু কোরবানিদাতারা। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ভয়াবহভাবে কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কমদামে বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৮০ হাজার টাকার গরুর চামড়ার দাম দিয়েছেন ২শ’ টাকারও কম। এক লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩শ’ টাকায়। চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানি দাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতেও পুঁতে দিচ্ছেন।

দুই তিন বছর আগেও ঈদের দিন সকাল থেকেই কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত। গ্রাম-গঞ্জে পাড়া-মহল্লায় চামড়া কেনার জন্য তারা অপেক্ষা করতো। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও হুজুরদেরও দেখা যেত। পশু কোরবানির পর চামড়া নিয়ে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মধ্যে টানাটানিও হতো। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনও দৃশ্য দেখা যায়নি।

মৌসুমী ব্যবসায়ী ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ভালো চামড়া গড়ে ৩শ’ টাকার কম দরে সংগ্রহ করতে পেরেছেন। আর সেই চামড়া পাইকাররা গড়ে ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা করে চামড়া কিনছেন।

এদিকে গতকাল সোমবারের (১২ আগস্ট) মতো আজও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কিনছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। একইভাবে গতকালের মতো আজও স্যায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পাইকারদের কাছে মাত্র ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় চামড়া বিক্রি করছেন। অন্যদিকে, পোস্তা ও হাজারীবাগ এলাকাতেও পাইকার, ট্যানারি প্রতিনিধি ও আড়তদাররাও অল্পদামে কোরাবানির পশুর চামড়া কিনছেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, যে দামে চামড়া কিনেছেন তার চেয়েও কম দামে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

উল্লেখ্য, এ বছর গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। সারা দেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা।