রাজনীতির খবর: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায়ই তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি (জাপা) ভেঙেছে পাঁচবার। বারবার দেখা দিয়েছে অস্থিরতা ও নাটকীয়তা। এমনকি এখনও অব্যাহত রয়েছে এ ধারা। তার মৃত্যুতে দলের চেয়ারম্যানের শূন্য পদে বসতে এবং বিরোধীদলীয় নেতা হতে লড়াই শুরু হয়েছে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে।
এরশাদের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন তার অনুসারীরা। এরশাদের চেহলামের পাঁচ দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার রওশন এরশাদকে পাল্টা চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন তার অনুসারীরা। এর আগের দু’দিন বিরোধীদলীয় নেতা হতে স্পিকারকে পাল্টাপাল্টি চিঠি দিয়েছিলেন জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ।
দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা পেতে নির্বাচন কমিশনেও পাল্টাপাল্টি চিঠি দিয়েছেন তারা। রওশন চিঠি দিয়েছেন গতকাল। আর জিএম কাদের দিয়েছেন দিন চারেক আগে। উভয় চিঠির সত্যতা নিশ্চিত করেছে ইসি সূত্র। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য রংপুর-৩ আসনে জাপার প্রার্থী মনোনয়নে গতকাল পাল্টা পার্লামেন্টারি বোর্ডও গঠন করেন রওশন। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর জাপার সংসদীয় দলের সভা ডেকেছেন তিনি। দুই পক্ষই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে সরকারের সঙ্গে। চেষ্টা করছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের। গুঞ্জন রয়েছে, জিএম কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে গত বুধবার সাক্ষাৎ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রওশন ও জিএম কাদের শিবিরের মধ্যে পাল্টাপাল্টি চললেও সারাদিনে দেখা মেলেনি দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার। রওশনের গঠিত পার্লামেন্টারি বোর্ডে তাকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। গত মাসে গঠিত জিএম কাদেরের গঠিত বোর্ডেও তিনি সদস্য সচিব। দুই পক্ষই দাবি করেছে, মহাসচিব তাদের সঙ্গে রয়েছেন। জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে চিঠিতে সই করলেও রাঙ্গা কোন পক্ষে রয়েছেন, তা জানা যায়নি তার মুখ থেকে।
জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন রওশন এরশাদ। গতকাল ভাবি রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পর দেবর কাদের তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ‘মায়ের মতো সম্মান করা’ রওশনকে যারা চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জিএম কাদের।
বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে গত মঙ্গলবার স্পিকারকে চিঠি দেন জিএম কাদের। জাপার ২৫ এমপির ১৫ জন সই করেন তাতে। পরদিন রওশন এরশাদ পাল্টা চিঠি দিয়ে স্পিকারকে অনুরোধ করেন, জিএম কাদেরের চিঠি যেন আমলে না নেওয়া হয়।
গতকাল গুলশানের বাসভবনে পূর্বঘোষিত সংবাদ সম্মেলন করেন রওশন। এতে তাকে দলের চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা করেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, এরশাদ জীবদ্দশায় কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে যান। তার মৃত্যুর পর জাপার গঠনতন্ত্রের ২০-এর ২(ক) ধারা অনুযায়ী সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানের দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার কথা। এই ধারা অনুযায়ী রওশন দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
আনিসুল ইসলাম বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্থায়ী চেয়ারম্যান ঠিক করা হবে। জিএম কাদের গঠনতন্ত্র ভেঙে চেয়ারম্যান হয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের সম্মান দেবেন রওশন এরশাদ।
এ সংবাদ সম্মেলনের ঘণ্টাখানেক পর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন জিএম কাদের। তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। দলের প্রেসিডিয়াম তাতে সর্বসম্মত সমর্থন দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্য নেতারা কথা বললেও অধিকাংশ সময় নীরব ছিলেন রওশন এরশাদ। তাকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করার পর তিনি বলেন, ‘পার্টি এখন উদ্বিগ্ন। জাপা অতীতেও ভাগ হয়েছে, এবারও তা হচ্ছে নাকি? হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এত কষ্ট করে পার্টি গড়ে তুলেছেন। এখন সেই পার্টি ভালোভাবে চলুক, মান-অভিমান করে যারা চলে গেছে, তারা ফিরে আসুক। পার্টির সবাই মিলেমিশে জনগণের সেবা করব।’
বনানীতে সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের বলেন, ‘রওশন এরশাদ মায়ের মতো। তিনি নিজ মুখে তো বলেননি- তিনি চেয়ারম্যান। তাকে সম্মান করি। আশা করি, তিনি এমন কিছু করবেন না, যাতে তার সম্মান নষ্ট হয়।’ দল ভাঙনের মুখে পড়েনি বলে দাবি করেন কাদের। রওশনকে যারা চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ঘোষণা করলেই কেউ রাজা হয় না। রাজা হতে রাজত্ব লাগে, প্রজা থাকতে হয়।’
রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে ছয়জন এমপিসহ জাপার ১০ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত ছিলেন। জিএম কাদেরের সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন ছয়জন এমপি ও ১২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। উভয় সংবাদ সম্মেলনেই ছিলেন বরিশাল-৩ আসনের এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু। তিনি বলেন, রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের মধ্যে যে সমস্যা, তা পারিবারিক। তাদের ঘিরে কিছু ‘বাটপাড়’ রয়েছে। ‘বাটপাড়রা’ নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে রওশন ও কাদেরকে উস্কে দেন। অস্থিরতা সৃষ্টি করেন।
টিপু বলেন, জাপায় এসব অস্থিরতা নতুন নয়। অতীতে বহুবার হয়েছে। এখন যা চলছে, তাও মিটে যাবে। দেবর-ভাবির দূরত্ব মেটাতে দুই সংবাদ সম্মেলনেই ছিলেন তিনি। দুইজনের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি করলেই সমস্যা মিটে যাবে।
জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, এরশাদ পরিবারের আলোচনায় প্রস্তাব ছিল- জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদে মেনে নেবেন রওশন এরশাদ। তিনি হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। বিরোধীদলীয় উপনেতা হবেন জিএম কাদেরের পছন্দের কেউ। রংপুর-৩ আসনে মনোনয়ন পাবেন রওশনপুত্র রাহগীর আল মাহী (সাদ এরশাদ)। কিন্তু জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের অনুসারীদের ‘উস্কানিতে’ এ সমঝোতা ভেস্তে গেছে।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ জানিয়েছেন, জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন এরশাদ। তিনি ধৈর্য ধরলে কাউন্সিলে গণতান্ত্রিক উপায়ে চেয়ারম্যান হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে নিজেকে একতরফা চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। রওশন এরশাদের সঙ্গে আলোচনা করে কাজটি করলে এ অবস্থা হতো না।
জাপার আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আলোচনার প্রয়োজন নেই। তার দাবি, রওশন এরশাদ যদি জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদে মেনে নিতেন, তাহলে বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে এত বিরোধ হতো না। এরশাদের স্ত্রী হিসেবে উপনেতা থেকে তিনিই বিরোধীদলীয় নেতা হতেন। জিএম কাদেরও তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু এরশাদের চেহলামের দিন জিএম কাদেরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলেন।
এরশাদ বেঁচে থাকতেই পদ বণ্টন ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিয়ে বারবার বিরোধে জড়ান জিএম কাদের ও রওশন। এরশাদ তা সামাল দিয়েই দল চালান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দুই পক্ষই দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমেছে।