খোলা মত

ঈষিকাধিপতি শিল্পী জলিল এর প্রস্থান -হাফিজুর রহমান মাসুম

By Daily Satkhira

September 14, 2019

পৃথিবীর কঠিনতম সত্য হলো মৃত্যু। গ্রীক কবি সিমোনিদেস (খ্রি. পূ. ৫৫৬-৪৬৮) লিখেছিলেন-

“যারা জন্মেছিল আমাদের বহুদিন আগে

যারা দেবতার পুত্র, যারা সব দেবতার মতো

তারাও পায়নি মুক্তি জরা থেকে

দুঃখ থেকে-

তাদেরও জীবনে মৃত্যু এসেছিল একদিন।”

 

চিত্রশিল্পী এম. এ জলিল আমার প্রতিবেশী। শৈশবের পরিচয় যৌবনে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিতে দেরি হয়নি। আমাদের সম্পর্ক মনের দূরত্ব অতিক্রম করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে সাতক্ষীরাতে থিতু হওয়ায়। শৈশবের প্রতিবেশী এম. এ জলিল হয়ে ওঠেন হৃদয়ের জলিল ভাই। ঈষিকা’র আড্ডায় আমি নিয়মিত হই ২০০৬ সাল থেকে। বয়সের বড় ধরনের পার্থক্য হৃদ্যতার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি চিন্তার নৈকট্যের কারণে। তিনি যেমন ভালো শ্রোতা ছিলেন, তেমনি ছিলেন ভালো পাঠক। কোন ভালো বইয়ের রেফারেন্স পেলে সেটা সংগ্রহ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত প্রায় সব ধরনের জনপ্রিয় অভিধান তার সংগ্রহে ছিল, রাখতেন ঈষিকাতেই। তার কয়েকটি অভিধানের সরবরাহকারী ছিলাম আমি নিজেই।

আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার আগেই জলিল ভাই খুশবন্ত সিং এর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রথম দিকের আলাপচারিতায় আমি তাকে খুশবন্ত সিংয়ের আরো কিছু লেখার কথা জানাই। Sex Scotch and Scholarship এবং Women and Men in My Life বই দু’টো নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল ঘনিষ্ঠতার শুরুর দিকে। খুশবন্ত সিং একেবারেই সাধারণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে লিখেও পাঠকপ্রিয় হয়েছিলেন ভাষার সাবলীল প্রয়োগের কারণে। যদিও লেখার ধরনের কারণে অনেকের সাথেই তার সম্পর্কের স্থায়ী অবনতি ঘটে।

Women and Men in My Life একটি ছোটখাটো বই। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর ভূমিকা। লেখক মানুষের জীবনের বন্ধুত্ব ও অন্যান্য সম্পর্ককে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটিকে তিনি তার ভাষায় by the accident of birth -বলে অভিহিত করেছেন, অন্যটি হচ্ছে মানুষের জীবনে চলার পথে তৈরি হওয়া সম্পর্ক। জলিল ভাইয়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক এই দ্বিতীয় ধারার। জলিল ভাইয়ের ছোট শ্যালক আমার মামাতো বোনের স্বামী। সেই অর্থে জলিল ভাই আমার বেয়াই। কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে জলিল ভাই আমার এবং আমাদের কাছে ঈষিকাধিপতি, আমাদের আত্মার আত্মীয়- ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।

বছর দুয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় জলিল ভাইয়ের হার্টে রিং পরানো হলো। এরপর বেশ ছিলেন তিনি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে হয়ে গেলেন খুবই হিসেবী। তৈলাক্ত খাবার তিনি খেতেন না বললেই চলে। কোমল পানীয় ছুঁয়েও দেখতেন না। নানা ধরনের ভেষজ উপাদানের মিশ্রণ তৈরি করে সব সময় ঈষিকাতে রাখতেন কৌটা ভরে।নিজেও খেতেন নিয়ম করে, অন্যদেরকেও খাওয়াতেন। দুধ এবং মিষ্টি জাতীয় জিনিস খেতেনই না, পান করতেন চিনি ছাড়া লাল চা।

জলিল ভাইকে সারাক্ষণ চাপে থাকতে হতো। যতটুকু চাপ সইবার ক্ষমতা তার ছিল, তার চেয়ে বেশি চাপ তাকে নিতে হতো। ব্যবসার চাপ ছিল, ছিল যে কোনো ছোটখাটো সমস্যায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার অভ্যাস। ছেলেদের লেখাপড়া-ক্যারিয়ার, স্ত্রীর কর্মস্থল, সর্বোপরি নিজের ভেতরে শিল্পসৃষ্টির তীব্র আকাঙ্ক্ষা পূরণের চাপও ছিল অনেক। শেষের দিকে জলিল ভাই চাপে অনেকটা ন্যুয়ে পড়েছিলেন।

জলিল ভাই ছিলেন ভীষণ রকমের ফ্যাশন সচেতন মানুষ। পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পাঁচজনের মধ্যে পঞ্চম জন, যার দিকে সহজেই সবার নজর যেত। নিজেকে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করতেন। আমরা মজা করে বলতাম, চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি তার পোশাক পরিচ্ছদেরও একটি প্রদর্শনী হওয়া দরকার।

ঈষিকা ছিল জলিল ভাইয়ের প্রাণ। গুরুতর অসুখ-বিসুখ না হলে তিনি ঈষিকায় নিয়মিত বসতেন। তিনটি একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন প্রত্যেকটির নাম দিয়েছেন ঈষিকার অর্কেস্ট্রা। ঈষিকার নিয়মিত আড্ডার কোন সভ্য(এখানে কেউ আনুষ্ঠানিক সভ্য ছিলেন না) যদি টানা কয়েক দিন অনুপস্থিত থাকতো, জলিল ভাই নিজে বা অন্য কাউকে দিয়ে তার খবর নিতেন। সাধারণত কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমাদের দাওয়াত হতো ‘ঈষিকা পরিবার’ নামে। ঈষিকার মালিক জলিল ভাই ছিলেন বটে, কিন্তু ঈষিকার আড্ডায় কারো একক কর্তৃত্ব ছিল না। জলিল ভাই ছিলেন সেই রাজা, যার রাজত্বে আমরা সবাই রাজা। তাই তার সাথে মিলতে আমাদের কারো কোনো বাধা ছিলো না। পেশাগত কারণে কাস্টমারদের অত্যাচার তাকে সইতে হতো নিয়মিত। হয়তো শুক্রবার বা কোন বিশেষ ছুটির দিনে ডিজাইনের ছেলেরা ছুটিতে আছে, কিন্তু কোন বিশেষ ব্যক্তি নাছোড়বান্দার মতো তাকে ধরলেন তার কাজটি করে দিতেই হবে। জলিল ভাই সহজে কাউকে না বলতে পারতেন না, শুরু হয়ে যেতো তার টেনশন।

কাস্টমারদের অত্যাচারের বাইরেও জলিল ভাইয়ের উপর অত্যাচার ছিল আমাদের সবার। ছুটির দিনে আমাদের দখলদারিত্বের কারণে তার বসার চেয়ার থাকতো না। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বহুদিন এমন ঘটেছে যে, নতুন কাস্টমার এসে ঈষিকার মালিক কে- তাই চিনতে পারতেন না।

আড্ডার বন্ধুদের নিয়মিত আপ্যায়ন করার চাপতো ছিলোই। যখন আড্ডার সভ্যদের কারো সাথে কারো বড় রকমের মনোমালিন্য হতো, সবচেয়ে ব্যথিত হতেন জলিল ভাই। প্রধানত তাঁর উদ্যোগেই পরবর্তীতে এসব মনোমালিন্যের অবসান হতো। জলিল ভাইয়ের মন খারাপ থাকলে আমরা তার মন ভালো করার জন্য চেষ্টা করতাম। কারণ, জলিল ভাইয়ের মুড ভালো করতে না পারলে সেদিনের আড্ডাটাই মাটি হয়ে যেতো। ঈষিকা অনেকের কাছেই সাতক্ষীরার কফি হাউজ। আজো ঈষিকার সেই সাজানো বাগান আছে, শুধু সেই বাগানের শ্রষ্ঠা সাড়ে তিন দশকের মালি শিল্পী এম. এ জলিল নেই। একে একে চলে যেতে হবে আমাদের সকলকেই। সেদিন হয়তো নতুন কোনো গায়ক গাইবে- “ঈষিকার আড্ডাটা আজ আর নেই…।”

আমাদের বিস্মিত করে গত কয়েক মাসে জলিল ভাইয়ের দফায় দফায় অসুস্থ হওয়া, কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়ে চলে যাওয়া- এসবই জীবনের সত্য। আমরা জানি এ সত্য, তবু মেনে নিতে পারি না। মুত্যু আমাদেরকে বারবার শোনায় তার জয়গান।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

“আমি মৃত্যু-রাখাল

সৃষ্টিকে চরিয়ে চরিয়ে নিয়ে চলেছি

যুগ হতে যুগান্তরে”

 

আগেকার দিনে রাস্তার পাশে বটগাছ থাকতো মানুষের বিশ্রামের জন্য। আমাদের অশান্ত নাগরিক জীবন আর যান্ত্রিক ব্যস্ততার ভিড়ে প্রাণ জুড়ানো শান্তির ছায়া দিতো যে বটবৃক্ষ, তিনি শিল্পী এম. এ জলিল। আমাদের ঈষিকাধিপতি জলিল ভাই ছিলেন এক শান্ত সমুদ্র। আমরা সবাই তাতে টালমাটাল জোয়ার।

আমরা তার প্রস্থানের পথে শুনতে পাচ্ছি-

“Please, don’t cry.

Just because we had to part,

As long as you remember me,

I’ll live in your heart.”

লেখক: সম্পাদক, ডেইলি সাতক্ষীরা ও সাধারণ সম্পাদক, নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা।