রাজনীতির খবর: ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ৭২ জনের বিরুদ্ধেই নানা অভিযোগ রয়েছে। মাদকের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট রয়েছেন ছয়জন। ১৫ জন বিবাহিত। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এমন একাধিক নেতাও কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। জামায়াত পরিবারের সন্তান ও গোপনে শিবিরের রাজনীতি করেছেন এ রকম কয়েকজনও ছাত্রলীগের পদে আছেন। সদ্য পদত্যাগকারী ছাত্রলীগ সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানীর জেলা মাদারীপুর থেকেই কমিটিতে ঠাঁই হয়েছে ২২ জনের।
ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির সদস্যদের ব্যাপারে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের হস্তক্ষেপে উদ্ভূত সংকট নিরসন করা যেতে পারে।
সদ্য পদত্যাগকারী ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সেক্রেটারি গোলাম রাব্বানী চলতি বছরের মে মাসে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটি ঘোষণার পরপরই পদবঞ্চিতরা অভিযোগ করেছিলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে অছাত্র, মাদক, হত্যা মামলার আসামি, চাকরিজীবী ও বিবাহিতরা স্থান পেয়েছেন। পদপ্রাপ্তদের অনুসারী ও পদবঞ্চিতদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়। চাঁদাবাজি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কিতদের জায়গা দেওয়াসহ নানা অভিযোগে রোববার পদ হারান ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন ও সেক্রেটারি রাব্বানী।
এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের মুখপাত্র ও বিতর্কমুক্ত ছাত্রলীগ আন্দোলনের নেতা রাকিব হোসেন বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই কমিটির ১০৫ জন সংগঠনে থাকার যোগ্য নন। আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কমিটিতে মাদকাসক্ত, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, বিবাহিত ও অযোগ্যদের স্থান করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন। তাহলে কেন মাদকাসক্তরা কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছে?
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্রলীগের সহসভাপতি তানজীল ভূঁইয়া তানভীরের বয়স ত্রিশের বেশি। সহসভাপতি রেজাউল করিম এনবিআরে চাকরি করছেন, সোহান খান প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত, আরেফিন সিদ্দিক সুজন মাদক কারবারে জড়িত ও তার পিতা মাদারীপুর জেলার পাঁচখোলা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির ছিলেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি মাদকসক্ত, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত এবং রাজনীতিতে অনিয়মিত। আরেক সহসভাপতি বরকত হোসেন হাওলাদার শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার হয়েছেন। আবু সালমান প্রধান শাওন মাদকাসক্ত ও রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়। শাহরিয়ার কবির বিদ্যুতের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারি। সহসভাপতি ফুয়াদ রহমান খান রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়, সাদিক খান বিবাহিত, মাদকাসক্ত ও রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়, তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সন্তান, এস এম তৌফিকুল হাসান সাগরের বাবা যুদ্ধাপরাধী, তৌহিদুর রহমান হিমেল ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, মাহমুদুল হাসান জামায়াত পরিবারের সন্তান, শহিদুল ইসলাম রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয় ও চাকরিজীবী, সুজন ভূঁইয়া অগ্রণী ব্যাংকে চাকরিরত, তৌহিদুর রহমান পরশ আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না, কামাল খান কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, সৈয়দ আরিফ হোসেন পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অগ্নিসংযোগে জড়িত, খালিদ হাসান নয়ন মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ও বয়স ত্রিশোর্ধ্ব, আবু সাঈদ ছাত্রলীগ থেকে আজীবন বহিস্কৃত, আমিনুল ইসলাম বুলবুলের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় মামলা রয়েছে (নম্বর ৪, ধারা-৩০২/৩৪)। তানজিদুল ইসলাম শিমুল রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়, রুহুল আমিন সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিবাহিত, সোহানী হাসান তিথি বিবাহিত। মাহমুদুল হাসান তুষার গোপনে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অগ্নিসংযোগকারী। এস এম হাসান আতিক ৩৯তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত ও বিবাহিত, সুরঞ্জন ঘোষের বয়স ত্রিশের বেশি। আরেক সহসভাপতি রাকিব উদ্দিন ঠিকাদার ও সোহেল রানার বয়স ত্রিশের বেশি। তা ছাড়া আগে তিনি ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। আয়ানাল সর্দার রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়, মুনমুন নাহার বৈশাখী জামায়াত পরিবারের সন্তান ও বিবাহিত। সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম বিভিন্ন মামলার আসামি ও নিয়োগ-বাণিজ্য প্রতারণায় যুক্ত।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে অগ্নিসংযোগে জড়িত, শাকিল ভূঁইয়া বিএনপি পরিবারের সন্তান। তার বাবা খোকন ভূঁইয়া মাদারীপুর পৌরসভা ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক। মোর্শেদুল হাসান রূপম সাবেক ছাত্রদল নেতা ও রাজনীতিতে নিষ্ফ্ক্রিয়। সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌস আলম জামায়াত পরিবারের সন্তান। তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে। সহসম্পাদক জাফর আহমদ ইমন সাবেক ছাত্রদল নেতা। তা ছাড়া এর আগে তিনি ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। শরিফুল ইসলাম কোতয়াল ও সোহরাব হোসেন শাকিলও অতীতে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। আসিফ রায়হানের বাবা চাঁদপুর জেলার গুপ্তি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। তানভীর আব্দুল্লাহ অতীতে ছাত্রলীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না। তিনি একজন ব্যবসায়ী। সামিয়া সরকার বিবাহিত। তার বাবা আব্দুস সবুর সরকার গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মনোনীত ওয়ার্ড কাউন্সিলর। ফারজানা ইয়াসমিন রাখি বিবাহিত। তামান্না তাসনিম তমা বিবাহিত ও আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। মেহেদী হাসান রাজু এসআই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হন। রেজাউল করিমের বয়স ত্রিশের বেশি। আঞ্জুমানারা অনু বিবাহিত ও প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। সহসম্পাদক শেখ আরজু বিবাহিত।
বিশেষ এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উপপ্রচার সম্পাদক রায়হান রনি আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। সিজাদ আরেফিন শাওন বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আব্দুল্লাহ বিন মুন্সি কোটাবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক। উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক সৌরভ নাথ চাঁদাবাজির মামলায় তিন মাসের সাজাপ্রাপ্ত আসামি। উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক আফরিন লাবণী বিবাহিত। উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ফুয়াদ হাসানের বয়স ত্রিশের বেশি। তিনি মাদক কারবারেও জড়িত। ওয়াহিদুজ্জামান লিখন আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। উপ-পাঠাগার সম্পাদক রুশী চৌধুরী বিবাহিত। ধর্মবিষয়ক সম্পাদক তাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। উপ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মনিরুজ্জামান তরুণ, উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সালেকুর রহমান শাকিল ও উপ-স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সম্পাদক ডা. শাহজালাল আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। উপ-গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন জসীম ওয়ারী ওয়ার্ড শাখা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। শুশোভন অর্ক একটি অনলাইন পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক আসিফ ইকবাল অনিক বিবাহিত, উপ-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়বিষয়ক সম্পাদক মো. তুষার আগে ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন না। রাকিবুল ইসলাম সাকিব বিবাহিত। উপ-আপ্যায়ন সম্পাদক শাহরিয়ার মাহমুদ রাজু মাদকাসক্ত; জসীম উদ্দীন হলের ৩২১ নম্বর রুমে ইয়াবা সেবনকালে আটক হয়েছিলেন। উপ-মানব উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক হীরণ ভূঁইয়া ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত। বেলাল হোসেন মুন্না ও কৃষি শিক্ষা সম্পাদক মাকসুদুর রহমান মিঠু বিবাহিত। উপ-প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক মেশকাত হোসেন সাংবাদিকদের কক্ষ ভাংচুর করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বছরের জন্য বহিস্কৃত হন। উপ-কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক অভিমিন্যু বিশ্বাস অভি ইউনানি ওষুধ ব্যবসায়ী।
অভিযুক্তদের একজন শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ। তিনি বলেন, ‘একটি বিশেষ মহল আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। আমি মাদকের সঙ্গে যুক্ত, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। আমরা তিন পুরুষ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। খোঁজ নিয়ে দেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির কতজন ছাত্রলীগের রাজনীতি করছে। সেই ফ্যাকাল্টির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নই।’
সূত্র: দৈনিক সমকাল