রাজনীতির খবর: জাতীয় সম্মেলনের আগে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম চার সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। টেন্ডার ও চাঁদাবাজ, অনুপ্রবেশকারী, অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনাকারী ও এর পৃষ্ঠপোষকসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা বাদ পড়তে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং দলীয়ভাবে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের অপকর্মের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি তালিকাও প্রণয়ন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের ৭টি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে ৪টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলো হল- যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগ। ২০১২ সালের ১১ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ১৪ জুলাই যুবলীগ, ১৭ জুলাই শ্রমিক লীগ এবং ১৯ জুলাই কৃষক লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল।
৩ বছর মেয়াদি কমিটিগুলো ২০১৫ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। সংগঠনগুলোর একাধিক নেতা বলেন, এতদিন সম্মেলেনর নাম মুখে আনাও পাপ ছিল। যারা নেতৃত্বে আসার মতো যোগ্য তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ক্যাসিনো তথ্য ফাঁস হওয়ার পর দুর্নীতিবাজদের চরিত্র উন্মোচন হয়েছে। সংগঠনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজদের অনেকে চিহ্নিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের জোর নির্দেশ দেয়ায় এখন আর কোনো বাধা নেই। আশা করি সম্মেলনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্বে বেরিয়ে আসবে। সংগঠন রাহুমুক্ত হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তিন সহযোগী সংগঠন- যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগের সম্মেলন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্দেশ দিয়েছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলে যারা অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কর্মকারী আছেন তাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। দলের নাম ভাঙিয়ে যারা অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে আছে। তারা কেউই ছাড় পাবেন না। আগামী সম্মেলনে তাদের কেউ পদ পাবেন না।
আওয়ামী লীগের কমপক্ষে তিনজন শীর্ষ নীতিনির্ধারক প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেন, দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী নেতাদের বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছেন।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তিনি বলেন, কে কাকে কিভাবে শেল্টার দেয় তা জানা আছে। যারা দলে অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের আমলনামাও আমার হাতে। অপরাধীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলে দিয়েছি, যা করার তারাই করবে।
চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠার পরপরই ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সংগঠনটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে যুবলীগ নেতাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী যুবলীগে কিছু মনস্টার (দানব) তৈরি হয়েছে। যারা ছাত্রলীগের চেয়েও খারাপ। এরপর থেকে বেরিয়ে আসে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের ক্যাসিনোসহ নানা অপকর্মের চিত্র।
এদিকে চলমান শুদ্ধি অভিযানে যুবলীগের রাঘববোয়ালরা ধরা পড়লে একে একে বেরিয়ে আসে প্রভাবশালী অন্যান্য নেতাদের নাম। ইতিমধ্যে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া যুবলীগ সভপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। গ্রেফতার এড়াতে সিঙ্গাপুরে আছেন এ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মুমিনুল হক সাঈদ। যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসসহ বেশ কয়েকজনকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামীমকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এসব নেতা আগামী কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন বলে নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতা।
তারা আরও জানান, যুবলীগের আসন্ন সম্মেলন থেকে বর্তমান কমিটির চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক থেকে অধিকাংশ নেতা বাদ পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। ক্যাসিনো অভিযানের পর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এ সংগঠনের অনেক নেতার নাম গণমাধ্যমে ওঠে এসেছে।
অপরদিকে যুবলীগ চেয়ারম্যানের বর্তমান বয়স ৭১ আর সাধারণ সম্পাদকের ৬৫। সেদিক থেকেও নতুন কমিটিতে চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ থাকছেন না- এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে এ পদ দুটোতে বেশ কয়েকজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির যুবলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতার নাম শোনা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) যাকে যেখানে ভালো মনে করেন তাকে সেখানে দায়িত্ব দেবেন। এ নিয়ে আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। তিনি সময় দিলেই আমরা সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু করব।
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে ইতিমধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা আবু কাওছারসহ সংগঠনটির কমপক্ষে হাফ ডজন কেন্দ্রীয় নেতার নাম আলোচনায় এসেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আসন্ন সম্মেলনে মোল্লা কাওছারকে নেতৃত্বে নাও রাখা হতে পারে।
বিশেষ সুবিধায় দীর্ঘদিনের কমিটি ভাঙতে অনীহা থাকলেও এবার সম্মেলন করতেই হচ্ছে কৃষক লীগকে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা কৃষক লীগের কার্যক্রমে মোটেও সন্তুষ্ট নয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশে আসন্ন সম্মেলনে নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে।
কৃষক লীগের বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা। দলে ও কৃষিতে তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় এবার পদ ধরে রাখা প্রায় অসম্ভবই হয়ে পড়তে পারে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক অবস্থাও স্থবির হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। শ্রমিক লীগের সভাপতি পদে শুক্কুর মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক পদে মো. সিরাজুল ইসলাম দায়িত্বে আছেন। আসন্ন সম্মেলন উপলক্ষে সংগঠনটিতে একঝাঁক কেন্দ্রীয় নেতা লবিং করছেন।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সম্মেলনের প্রস্তুতি আরও এক বছর আগে নেয়া হয়েছে। সংগঠনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী যাকে দেবেন আমাদের আপত্তি নেই। তাছাড়া আমাদের দায়িত্ব পালন তাকে কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পেরেছে তার ওপর আমাদের থাকা না থাকা নির্ভর করবে।সূত্র: যুগান্তর