আজকের সেরা

জামিন নামঞ্জুর, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার ফজলু কারাগারে

By Daily Satkhira

October 22, 2019

ডেস্ক রিপোর্ট: সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নামে ১৬ কোটি ৩১ লক্ষাধিক কোটি আত্মসাতের মামলায় সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর কিপার ফজলুর রহমানের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমানের আদালত এ আদেশ প্রদান করেন।

এঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাতক্ষীরাস্বাস্থ্য খাতের দুর্নীীতবাজদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরার সভাপতি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, সাতক্ষীরা ও দেশের স্বাস্থ্য খাতে স্টোর কিপার ফজলু এক মহদুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। তার জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় সমাজে একটি ভালো বার্তা যাবে। নাগরিকরা দীর্ঘদিন থেকে তার গ্রেফতার দাবি করছিল। একই সাথে ফজলুর মত একজন কর্মচারী কাদের ছত্রছায়ায় কিভাবে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি করলেন সেটাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, দুর্নীীতর অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) মামলা দায়ের এবং দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা ফজলুর রহমান মঙ্গলবার সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন জানালে আদালত তা নামঞ্জুর করে। এসময় তার জামিনের বিরোধিতা করেন সাতক্ষীরায় দুদক এর প্যানেল আইনজীবী অ্যাড. মোস্তফা আসাদুজ্জামান দিলু, অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু, অ্যাড. মোস্তফা নুরুল আলম ও অ্যাড. মনির উদ্দীন। আসামি ডা. তৌহিদের পক্ষে জামিনের আবেদন জানান, অ্যাড. আব্দুল মজিদ।

উল্লেখ্য, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ১৮ কোটি টাকার মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতির ঘটনায় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করে বিচারের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করে। নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা মানববন্ধন ও অসংখ্যা প্রতিবাদ সভা করার পর গত ২৪ এপ্রিল সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও করে এবং প্রধানমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এ ঘটনায় দীর্ঘ তদন্ত শেষে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিন বাদি হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের পক্ষে এ মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার আসামি সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন তাওহীদুর রহমান, স্টোর কিপার ফজলুসহ ৯ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্র জানায়, পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, মামলার এসব আসামি দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন বলে দুদক বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছে। তাই তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন।

৯ জুলাই এই ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেন প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিন। আসামি‌দের নাম : ১. ডাঃ তাওহীদুর রহমান , সাবেক সিভিল সার্জন, সাতক্ষীরা। ২. এ,কে, এম ফজলুল হক, স্টোর কিপার , সিভিল সার্জন অফিস, সাতক্ষীরা। ৩. মোঃ আনোয়ার হোসেন, হিসাব রক্ষক, সিভিল সার্জন অফিস, সাতক্ষীরা। ৪. মোঃ জাহের উদ্দিন সরকার, প্রোপাইটর : মেসার্স বেঙ্গল সায়েন্টিফিক এন্ড সার্জিকেল কোং। ৫. মোঃ আব্দুর ছাত্তার সরকার, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর। ৬. মোঃ আহসান হাবিব, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর। ৭. মোঃ আসাদুর রহমান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর। ৮. কাজী আবু বকর সিদ্দীক, মাদারীপুর। ৯. এ,এইচ,এম আব্দুস কুদ্দুস, সহকারী প্রকৌশলী (অব:), নিমিউ এন্ড টিসি, ঢাকা।

মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যন্ত্রপাতির কোনো ধরনের চাহিদাপত্র না থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেন। জাল জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়, অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র সংগ্রহ, দরপত্র মূল্যায়ন ও কার্যাদেশ দিয়ে তিনটি মিথ্যা বিলের বিপরীতে মোট ১৬ কোটি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৮২৭ টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।

কে এই স্টোর কিপার ফজলু: কোটি কোটি টাকার মালিক সামান্য একজন স্টোর কিপার ফজলু। এজন্য আলাদীনের চেরাগ। গরিব রোগীরা যেখানে ঠিকমত ওষুধ পায়না সেখানে ফজলু গরিবের ওষুধ বিক্রি করে সম্পদের পাহাড় জমান। বার বার চাকুরি থেকে বরখাস্ত ও দুই বার দুদকের অভিযানে গ্রেপ্তার হলেও সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের আলোচিত দুর্নীতিবাজ স্টোর কিপার এ কে এম ফজলুল হককে নাগালের বাইরে রেখেছিল একটি পক্ষ। গত ২৪ এপ্রিল নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস ঘেরাও এবং দুদকের অভিযানের সময় স্টোরকিপারের স্টোরের চাবি নিয়ে পালিয়ে যান। প্রসঙ্গত, ২০১৬ ও ২০১৭ দুদকের মামলায় দুই দফা গ্রোপ্তার হয়ে চাকুরিচ্যুত হন ফজলুল হক। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২১ জুন সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয় এলাকা থেকে ফজলুল হককে গ্রেপ্তার করে করা হয়। দুদক সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা রিজার্ভ স্টোরের সরকারি ওষুধ আত্মসাৎ ও আত্মসাতে সহায়তায় তৎকালীন সিভিল সার্জন নাজমুল হক ও স্টোর কিপার এ কে এম ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানে দুদক কর্মকর্তারা ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ওষুধ ঢাকা থেকে গ্রহণ করে তা চুয়াডাঙ্গা রিজার্ভ স্টোরে মজুদ না করে বিক্রি করে দেন। এই অভিযোগে দ-বিধির ৪০৮/১০৯ এবং ১৯৭৪ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলা করা হয়। দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলাম মোড়ল বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে ওই দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার হলে তিনি আরো বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে, সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের ৭ কোটি ১০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা মূল্যের এমএসআর সামগ্রী আত্মসাতের ঘটনায় প্রাক্তন সিভিল সার্জন (অবঃ) ডাঃ সালেহ আহমেদ ও অফিসের স্টোর কিপার ফজলুল হকের বিরুদ্ধে দুদক ২০১৭ সালের ২১ মে রবিবার সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলাটি দায়ের করেন। এ ঘটনায় স্টোর কিপার ফজলুল হককে গ্রেফতার করে দুদক। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল-২ অধিশাখা বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৫ টাকার ক্রয়কৃত এমএসআর মালামাল সামগ্রী সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ সকল উপজেলা হাসপাতালগুলোতে বিতরণ করার জন্য পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট সিভিল সার্জন অফিস ইনডেন্ট নং-৩, অনুযায়ী এমএসআর মালামালগুলো সংগ্রহের জন্য সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইনডেন্ট প্রদান করা হয়। তৎকালীন নতুন সিভিল সার্জন উৎপল কুমার দেবনাথ সাতক্ষীরায় যোগদানের পর উক্ত মালামাল সংক্রান্ত ব্যাপারে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ ৫৬৮ নং স্মারকে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সদর হাসপাতালসহ উপজেলা হাসাপাতালগুলোতে তদন্ত কমিটি খোঁজ নিয়ে দেখেন, এ মালামালগুলো কোথাও সরবরাহ না করে স্টোর কিপার ফজলুল হক ও তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ সালেহ আহমেদ সেগুলো আত্মসাৎ করেছেন। তারা অভিযোগ করেন স্টোর কিপার ফজলুল হক স্টক রেজিস্ট্রারসহ অন্যান্য তথ্যাদি গোপন করে ৭ কোটি ৯৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৫ টাকার মধ্যে ৭ কোটি ১০ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৫ টাকার মালামাল সামগ্রী আত্মসাৎ করেছেন। দুদক’র সমন্বিত জেলা কার্যালয় খুলনার সহকারী পরিচালক মহাতাব উদ্দিন বাদী হয়ে উপরোক্ত ধারায় স্টোর কিপার ফজলুল হক ও তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ সালেহ আহমেদের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। অতঃপর স্টোর কিপার ফজলুল হককে গ্রেফতার করা হয়। সূত্র আরো জানায়, ফজলুল হক হাইকোর্ট থেকে বরখাস্ত আদেশ স্থগিত করে পুনরায় সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসে ২০১৭ সালে যোগদান করেন। যোগদান করে পুনরায় মেতে উঠেন দুর্নীতিতে। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা যায়, শহরের মধুমল্লার ডাঙ্গিতে তিনি ৫ কাঁঠা জমির উপর আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। যার মালিক তার স্ত্রী। পাশে ৮ কাটা জমির উপর আরো একটি বাড়ি আছে। পারিবারিক অন্য কোন আয়ের পথ না থাকলেও চাকরির উপর ভর করে কিনেছেন ট্রাক, মাইক্রো, গড়ে তুলেছেন পারিবারিক সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ব্যালেন্স। সব মিলিয়ে তিনি ও তার পরিবার কোটি কোটি টাকার মালিক। ২০১৬ সালে দুদক তার সম্পদের বিষয়ে খোজ খবর নিতে শুরু করলে এ তথ্যগুলো বেরিয়ে আছে। এ ছাড়াও নামে-বেনামে তিনি আরো সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন বলে স্থানীয়রা জানান।