জাতীয়

ডিসির দেওয়া চাকরি নেবেন না অভিমানী সেই মুক্তিযোদ্ধার পুত্র

By Daily Satkhira

October 26, 2019

দেশের খবর: দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) দেওয়া চাকরি নেবেন না অভিমানী সেই মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের ছেলে নূর ইসলাম। শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন নূর ইসলামের ভাই নূর হোসেন।

শেষযাত্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চাননি অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। মৃত্যুর দুই দিন আগে নিজের ক্ষোভ-দুঃখের কথাগুলো লিখে রেখে যান স্বজনদের কাছে। বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ১১টায় মারা গেলে পরদিন বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ইসমাইল হোসেনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শেষ বিদায় নেন প্রশাসনের স্যালুট ও বিউগলের করুণ সুর ছাড়াই।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে গেলে তার সন্তান নূর হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বাবাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সেই ঘটনার পর বাবা অসুস্থ হয়ে যান এবং পরবর্তী সময়ে মারা যান। জেলা প্রশাসক আমার ভাই নূর ইসলামকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে আমরা সেই চাকরি নেবো না।’

মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের আরেক ছেলে নূরুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রের সম্মানটুকু না নিয়ে আমার বাবা বিদায় নিয়েছেন। এই চাকরি আমরা কেন নেবো? জেলা প্রশাসক এসেছিলেন; তাকে সম্মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উনার দেওয়া চাকরি তো আমরা নিতে পারি না। কারণ, দুই মাস পর যে আবার চাকরি থেকে বের করে দেবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে! আমরা সরকারের প্রতিনিধি হুইপ ইকবালুর রহিমের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দিনাজপুর সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামে সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে আসেন ডিসি মাহমুদুল আলম। তিনি শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি তার কার্যালয়ে নূর ইসলামকে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেন।

এদিকে, মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অবহেলার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে বিভাগীয় প্রশাসন। তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে আসেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লোকমান হাকিম, দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী দুলাল।

তদন্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সরকার সচেতন। আমি ঘটনা তদন্তে এসেছি। ভিকটিম ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়েছি। নূর ইসলামকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে।’ তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

এর আগের দিন শুক্রবার দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, ঘরে খাটে বসে কান্নাকাটি করছেন তার স্ত্রী নূরনেহার বেগম। আর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য প্রতিবেশীরা এসেছেন। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার লোকমান হাকিম, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদ সরকার, মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আলীসহ অনেকে। মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের প্রতি অবহেলার ঘটনায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন দুলাল বলেন, ‘অনেক ক্ষোভ ও দুঃখ-কষ্ট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন মৃত্যুবরণ করেছেন। এসিল্যান্ড তার ছেলেকে দিয়ে বাড়ির কাজকর্ম করাতেন; একপর্যায়ে চাকরিচ্যুতও করেন। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে গেলেও তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন চিঠিতে গার্ড অব অনার না নেওয়ার কথা লিখেন। তার শেষ চাওয়া হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়। আগামীতে যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের প্রতি এমন অবিচার করা না হয়, এই বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।’

মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আলী বলেন, ‘নিহত মুক্তিযোদ্ধা আমার মামা। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়—এমন ঘটনা খুব খারাপ। মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব ও আমাদের জন্য বড় পাওয়া। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন এমন পাওনা থেকে কেন বঞ্চিত হলেন! এসবের তদন্ত দরকার; জড়িতদের বিচার করতে হবে।’

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ইমদাদ সরকার বলেন, ‘একজন ৯০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুকালে লিখে যাওয়া একটি চিঠি আমাদের ব্যথিত করেছে। আমরা চাই না, এ ধরনের ঘটনা আর হোক। এই বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।’

গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি চিঠি লিখেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। পরে এর নিচে সইও করেন। ওইদিনই তা ডাকযোগে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের ঢাকার ঠিকানায় পাঠানো হয়। এর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার (২৩ অক্টোবর) সকাল ১১টায় মারা যান জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) ইসমাইল হোসেনের জানাজার নামাজ শুরুর আগে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য হাজির হন। কিন্তু মৃত্যুর আগে চিঠিতে উল্লেখ করা ‘ইচ্ছা’ অনুযায়ী এই অভিমানী মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিতে দেবেন না বলে জানান তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা।

মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের লেখা চিঠির মূলকথা হলো, গত ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে তার ছেলে নূর ইসলাম ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে এসিল্যান্ডের গাড়িচালকের চাকরি পান। কিছুদিন আগে কর্মস্থলের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানাতে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন নূর ইসলাম। এসময় হুইপ সমস্যার বিষয়গুলো দেখার জন্য এডিসিকে (রাজস্ব) নির্দেশ দেন। এরপর হঠাৎ নূর ইসলামকে তার বসবাসরত ‘খাস পরিত্যক্ত’ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

মুক্তিযোদ্ধার চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে নুর ইসলামকে বাথরুম পরিষ্কারের পর মাংস রান্না করতে বলেন এসিল্যান্ডের স্ত্রী। এরপর সেদিন মাংস রান্না হয়নি—এমন অভিযোগ এনে নুর ইসলামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সঙ্গে দেখা করতে যান নুর ইসলাম। এসময় জেলা প্রশাসকও নুর ইসলামের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এর দুয়েক দিন পর এসিল্যান্ডের স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য যান নূর ইসলাম। এ সময় তার সঙ্গে ছিল স্ত্রী ও সন্তানেরাও। ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও তারা এসিল্যান্ডের স্ত্রীর দেখা পাননি। চাকরি চলে যাওয়ায় আর কোনও উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে ফের দেখা করেন নূর ইসলাম। এ বিষয়কে আরও নেতিবাচকভাবে নেয় প্রশাসন। পরে চাকরি ও থাকার জায়গা হারিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন নূর ইসলাম।

চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন লিখেছেন, ‘অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সে দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হলো! ২১ অক্টোবর থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগে (ওয়ার্ড-২, বেড-৪৪) চিকিৎসাধীন আছি। এখানে থেকেই এই পত্র তোমার কাছে (হুইপ ইকবালুর রহিম) লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন, তুমি ন্যায়বিচার করো। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমার বয়স প্রায় ৮০ বছর। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। ছেলে হঠাৎ চাকরিচ্যুত হওয়ায় মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমি। মৃত্যু হলে আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ, এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি—যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত-বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/স্যালুট আমার শেষযাত্রায় আমি চাই না।’