রাজনীতির খবর: আওয়ামী লীগে চলমান শুদ্ধি অভিযানের ঢেউ লেগেছে তৃণমূলেও। এ ব্যাপারে জেলা-উপজেলা নেতাদের সতর্ক করে শনিবার থেকে চিঠি পাঠানো শুরু করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
চিঠিতে অনুপ্রবেশকারী, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজ, বিতর্কিত, যারা দলে বলয় তৈরি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন ও ‘পদ বাণিজ্যে’র সঙ্গে জড়িত- এমন নেতাদের কোনো স্তরের কমিটিতে স্থান না দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন জায়গায় অনুপ্রবেশকারী, সুযোগসন্ধানী ও বিতর্কিতরা ঢুকে পড়েছে। এদের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। অনেক সময় বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে তৃণমূল সম্মেলনগুলো হচ্ছে। এটাই মুখ্য সময় এদের বিষয়ে সতর্ক থাকার। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেন কোনোভাবেই বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা দলে জায়গা না পায়।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার আজারবাইজান যাওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলে কাউন্সিলের (সম্মেলন) আয়োজন ও নতুন কমিটিতে বিতর্কিতদের না রাখার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। এরপর সেদিনই বিষয়টি নিয়ে ধানমণ্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে তৃণমূলে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। শুক্রবার এসব চিঠিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। শনিবার দুপুর থেকে এসব চিঠি জেলা-উপজেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ঠিকানা বরাবর কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো শুরু হয়।
আরও জানা গেছে, কিছুদিন আগে তৃণমূলে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব পর্যায়ের কাউন্সিল শেষ করে তা তালিকা আকারে কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়েছে। চিঠিতে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কমিটি থেকেও বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি চলমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানের অংশ বলে দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্র থেকে বলা হয়েছে।
এদিকে শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে গতি বেড়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল সম্মেলনেও। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা, উপজেলার কাউন্সিল শেষ করতে চান দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ইতিমধ্যে মাঠেও নেমে পড়েছেন তারা। প্রায় প্রতিটি জেলা, মহানগর ও উপজেলায় কর্মিসভা এবং বর্ধিত সভা করেছেন। এরপরই শুরু হয়েছে জেলা-উপজেলা কাউন্সিল। প্রায় অর্ধশত উপজেলা-থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনও। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বলছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সব উপজেলা এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে জেলা সম্মেলন শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
আওয়ামী লীগের আগের কমিটির মেয়াদে (২০১২ থেকে ২০১৬ সালে) ৫৮টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় সম্মেলনের পর ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে শুধু একটিতে (২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার) সম্মেলন হয়েছিল। বাকি প্রায় সবগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল। এর মধ্যে চাঁদপুর, কুমিল্লা দক্ষিণ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর ও গাইবান্ধাসহ কিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয় গত মার্চ, ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারিতে। আর বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও মাগুরাসহ বেশকিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর। কিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তারও আগে। আর উপজেলা-থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছিল অনেক আগেই।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল করার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের মেয়াদ উত্তীর্ণ সব কমিটির সম্মেলন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনার পরই মাঠে নামে আওয়ামী লীগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা। কোন কমিটির মেয়াদ নেই, কতদিন আগে মেয়াদ শেষ হয়েছে, কমিটি গঠনে কি কি সমস্যা রয়েছে- সেসব বিষয়ে সাংগঠনিক পরিকল্পনা তৈরি করেন তারা। এরই অংশ হিসেবে প্রায় ৭ বছর পর শনিবার ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ বাকি সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে ১৫ নভেম্বর কুমিল্লা উত্তর জেলা, ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, ১ ডিসেম্বর বরগুনা, ২ ডিসেম্বর পটুয়াখালী, ৩ ডিসেম্বর পিরোজপুর, ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা, ৭ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা ও বরিশাল জেলা, ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। অন্যগুলোর তারিখও খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, নেত্রীর (শেখ হাসিনার) বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তৃণমূলের সম্মেলন করার জন্য আমরা প্রায় প্রতিদিন আলাদাভাবে বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর করছি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, সাংগঠনিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদের যে ধারাবাহিক কার্যক্রম তা চলমান রয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ সব জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন করে গঠন করা হবে। রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় কমিটি আপডেট আছে। যেগুলোর মেয়াদ নেই, তা নিয়ে কাজ করছি। তবে কিছু জায়গায় সমস্যাও আছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।
খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যুগান্তরকে বলেন, আমরা জেলা-উপজেলার সম্মেলনের কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমার বিভাগে নভেম্বরের মধ্যে ৩৯টি উপজেলার সম্মেলন হবে। এছাড়া ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৪টির মতো জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান তিনি। চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মেয়াদ উত্তীর্ণ উপজেলার সম্মেলন হয়ে যাবে। জেলা সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজ (শনিবার) ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে বান্দরবান জেলার সম্মেলন হবে। এরপর কক্সবাজার আছে। কাল (রোববার) চট্টগ্রামে প্রতিনিধি সভা আছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সবগুলোর সম্মেলন শেষ করতে পারব।খবর-যুগান্তর