যশোর প্রতিনিধি: যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার প্রকল্পে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে যশোর। এমন প্রকল্প বাংলাদেশে যশোরেই প্রথম। এর মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনের পচনশীল বর্জ্য থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে জৈবসার, বায়োগ্যাস এবং বিদ্যুৎ।
পৌরসভার তত্ত্বাবধানে যশোর শহরতলীর ঝুমঝুমপুর ময়লার ভাগাড়ের ১৩ দশমিক ৯৭ একর (প্রায় ৪০ বিঘা) জমিতে তৈরি করা হয়েছে ‘ইন্টিগ্রেটেড ল্যান্ডফিল অ্যান্ড রিসোর্স রিকভারি ফ্যাসিলিটি’ প্রকল্পটি। ব্যয় করা হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এটি ‘সিটি রিজিওন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের’ আওতায় একটি উপ প্রকল্প। মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি সহায়তা দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (কেএফডব্লিউ) এবং সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন এজেন্সি (সিডা)।
প্রকল্পের সুপারভাইজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সারাদিন পৌরসভার ট্রাকে ট্রাকে বর্জ্য সংগ্রহ করে আনা হয়। এরপর সেটি ওজন স্টেশনে ওজন করার পর স্টোরেজে নেওয়া হয়। সেখানে বর্জ্যগুলো বাছাই করেন প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মীরা। এরপর সেখান থেকে পচনশীল দ্রব্য- যেমন তরকারি, ফলমূলের খোসা, ঘাস, পাতা ইত্যাদি (যেগুলো জৈব স্যার তৈরির উপযোগী) জৈবসার প্লান্টে চলে যায়। সেখানে মেশিনের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করে জৈবসার প্রস্তুতের জন্যে উপযোগী করা হয়। এগুলো পরে ২৮ দিনের জন্যে উপযুক্ত করা হয়। এরপর বয়লার মেশিনে শুকিয়ে জালি বা ছাকনির মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী জৈবসারে পরিণত করা হয়। এই সারের রঙ ও দানা একদম চায়ের দানার মতো হয়। পরে আমরা সেই সার প্যাকেটজাত করি।’তিনি জানান, ‘বাকি অংশ চলে যায় বায়োগ্যাস প্লান্টে। অপরদিকে, মনুষ্য বিষ্ঠা থেকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল অংশ ও শুকনো অংশও বায়োগ্যাস প্লান্টে পাঠানো হয়। এখানে চার থেকে পাঁচ দিন রাখা হয়। সেখান থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। আর বাকি অংশ (স্লাইস) জৈবসারে ব্যবহৃত হয়। উৎপাদিত বায়োগ্যাস দিয়ে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। আমাদের এখানে তিনটি জেনারেটর রয়েছে। যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কিলোওয়াট আওয়ার। উৎপাদিত বিদ্যুৎ গোটা প্লান্ট এরিয়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে।’
এই কর্মকর্তা জানান, ‘শহর ও শহরতলী থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্যের একটি বড় অংশ অপচনশীল। অর্থাৎ, প্লাস্টিক বা পলিথিনজাতীয়। সেগুলো ফেলা হয় ল্যান্ডফিল্ডে। অথচ দুই বছর আগেও শহরতলীর এই এলাকাটি ছিল পৌরসভার ডাম্পিং এরিয়া। ময়লার দুর্গন্ধে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে থাকতো। মানুষের চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দৃশ্যপট বদলে গেছে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয় এর বাস্তবায়ন। এই প্রকল্পে মোট ৪৭ জন কর্মী রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্লান্টে জৈবসার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক চার টন। বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ৮০০ কেজি থেকে এক টন পর্যন্ত। প্লান্টে দৈনিক ৭২০ কিউবিক মিটার বায়োগ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৪০০ কিউবিক মিটার। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে দৈনিক ৪৩০ কিলোওয়াট আওয়ার। বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২০০ কিলোওয়াট আওয়ার।
প্রকল্পের সুপারভাইজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যে পরিমাণ বর্জ্য এখানে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব, সে তুলনায় প্রতিদিন তা আসছে না। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে হলে আমাদের দ্বিগুণের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে।’
যশোর পৌর মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু বলেন, ‘শত বছরের ময়লার স্তূপ সরিয়ে জায়গাটিকে ব্যবহার উপযোগী করা কঠিন ছিল। অবশ্য সবার সহযোগিতায় সেটি সম্পন্ন করা গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় বর্জ্যের জন্য ঝিকরগাছা পৌর কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছিল। কিন্তু তারা দেয়নি। এখনও সার বিক্রির ব্যবস্থা করা যায়নি। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা ও দাম নির্ধারণ করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। একইসঙ্গে অপচনশীল দ্রব্যের বিকল্প ব্যবহারেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
যোগাযোগ করা হলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে সম্পদ তৈরির কাজ দেশের মধ্যে যশোরে প্রথম শুরু হয়েছে। এটি সুখকর বিষয়। অন্যান্য জেলার জন্য এটি রোল মডেল হতে পারে। ভারতে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণে যখন ছিলাম, সেখানে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এই প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যতদূর জানি, ভারত সরকার আমাদের দেশে এই খাতে বিনিয়োগ করতেও আগ্রহী। প্রকল্পের টেকনিক্যাল বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে, সায়েন্টিফিক্যালি যদি করা যায়, তবে আরও ভালো রেজাল্ট আশা করা যায়।’