দেশের খবর: নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের ভারত সফর আটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদি সরকারকে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে করছে ভারতের সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকা।
শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) ‘বিদেশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর আটকে বার্তা হাসিনার’ এমন শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে বৃহস্পতিবার বিকেলে দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু ওইদিন দুপুরে হঠাৎ করেই মন্ত্রী ভারত সফর বাতিল করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন না। অপরদিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার আমন্ত্রণে শুক্রবার সকাল ১১টায় সিলেটের তামাবিল হয়ে মেঘালয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে তিনিও সফর স্থগিত করেন।
নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতজুড়ে সহিংস বিক্ষোভের মধ্যেই বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীর দেশটিতে সফর বাতিলের এ সিদ্ধান্ত আসে।
আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নয়াদিল্লির বিমানে ওঠার কয়েক ঘণ্টা আগে সফর বাতিল করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ভারত ওশিয়ান সংলাপে যোগ দিতে তিন দিনের এই সফর বাতিলের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস (১৩ ডিসেম্বর) সামনেই। সেই অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত থাকতে হবে তাকে। একই সময়ে ওশিয়ান সংলাপের তারিখ পড়ায় তার আসা হল না।
শুক্রবার মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার আমন্ত্রণে শিলংয়ে যাওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের। রাতে তার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরে ‘উপযুক্ত সময়’ মন্ত্রী এই সফরে যাবেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যে সব অনুষ্ঠানের কারণ দেখিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল করা হলো, সেগুলো বহু বছর ধরে ওই দিনেই হয়! ওশিয়ান সংলাপের দিনও স্থির হয়েছে মাসখানেক আগে। তা হলে সম্মতি দিয়েও শেষ মুহূর্তে কেন বিমানে উঠলেন না মোমেন?’ কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘এই সিদ্ধান্ত সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বুধবার রাতে মোমেন হাসিনার বাসভবনে দেখা করতে গিয়েই এই নির্দেশ নিয়ে ফিরেছেন।
সম্প্রতি সংসদে পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি যে ঢাকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসরে গভীর অসন্তোষ তৈরি করেছে তা, এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়ে গেল। মোদি সরকারকে এতটা কড়া বার্তা দিতে সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি বলে মনে করছেন কূটনীতিকেরা।’
তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর বাতিল ও নাগরিকত্ব বিল পাসের বিষয়টিকে পৃথক ভাবে দেখছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে আনন্দবাজারের ওই প্রতিবেদনে।
রবীশ কুমারের বক্তব্য, অমিত শাহ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ভারত সরকার মনে করে সামরিক শাসন এবং খালেদা জিয়ার সময়েই সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসাই করেছেন অমিত শাহ।
আনন্দবাজার আরও জানায়, ঘটনার গতি থেকে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অসন্তোষ গভীরে। গতকাল রাতে নাগরিকত্ব বিল পাস হওয়ার পর এই মোমেনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতের নিজের দেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। বন্ধু দেশ হিসাবে আমরা আশা করছি ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়।’
তার কথায়, ‘বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রয়েছে যেখানে এত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে। উনি (অমিত শাহ) আমাদের দেশে কয়েক মাস থাকলেই দেখতে পাবেন, এখানকার সম্প্রীতি নজির হতে পারে।’
বাংলাদেশ সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিল পাসের সময় যে ভাবে বার বার পাকিস্তানের সঙ্গে একই বন্ধনীতে বাংলাদেশকে রেখে সংখ্যালঘু নিপীড়নের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে, তা হাসিনা সরকারের জন্য বিড়ম্বনার।
এতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু ও হাসিনার প্রশংসা করার পাশাপাশি অমিত শাহ বলেছেন, ‘একাত্তরের পরেও সে-দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।’ ঢাকা মনে করে, কার সময়ে কী ঘটেছে সেই কাদা বার বার ছোঁড়ায় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সার্বিক ভাবে একটি বার্তা গেছে। আওয়ামী লীগের কট্টর ইসলামি অংশকে ভারত-বিরোধিতার জিগির তোলায় উদ্বুদ্ধ করার পক্ষে তা যথেষ্ট। ভারত-বিদ্বেষী প্রচারের ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছে বিএনপিও।
আনন্দবাজার আরও জানায়, গত অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যে কূটনৈতিক কর্মকর্তারা ভারতে এসেছিলেন, তাদের মতে— আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জনমানসে।
ঘরোয়া রাজনীতিতে তা হাসিনার পক্ষে অনুকূল নয়। আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থী অংশ ভারত-বিরোধী প্রচার শুরু করলে ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত ও বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বাধার মুখে পড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। মাঝখান থেকে চীনের প্রতি নির্ভরতা বাড়বে ঢাকার।