আজকের সেরা

বোমায় সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়েছিলেন আব্দুল মালেক সোনা

By Daily Satkhira

December 16, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক: চারটি সেলাই মেশিনে দরজির কাজ করে ও কিছু নতুন কাপড় কেনাবেচা করে পরিবারের ভরণ পোষণ চলতো গ্রামের সহজ সরল যুবক শেখ আবদুল মালেক সোনার। এই সোনার বুকের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়েছিল একাত্তরের বারুদ। নেমেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরে একের পর এক যুদ্ধ করে জয় পরাজয় নিয়ে তিনিই সর্বশেষ সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউস (বিদ্যুৎ অফিস) টাইম বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর এর মাত্র ক’দিন পর ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হয়। বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে শত্রুমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর।

৭১ এর সেই দিনগুলির স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে শহরের অদুরে থানাঘাটা গ্রামের আবদুল মালেক সোনা বলেন এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা সাতক্ষীরা শহরে ঘাঁটি গেড়ে বসে। তারা শহরের কাজী মশহুর রহমান ও তার শ্যালককে গুলি করে হত্যা করে। এর পরই তিনি শহরে এসে দেখতে পান পাকিস্তানি বাহিনী শহরের কয়েকজনকে ধরে নির্মমভাবে মারধর করছে। তারা তার দরজির দোকান ভাংচুর করে লুটপাট করে। প্রাণভয়ে তিনি আর দোকানের দিকে না যেয়ে ফিরে যান। সোনা বলেন এ সময় আমার কানে বাজছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষন ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ’।

সোনা বলেন আমি, কুদরত ই খোদা কুদু, আবদুল্লাহ, মোতাহার, কাজী কামাল, নাজমুলসহ ছয়জন সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাবো। যে কথা সেই কাজ। সাতক্ষীরার বিপরীতে হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের কল্যানীতে পৌছে প্রাথমিক প্রশিক্ষন গ্রহণ করি। পরে বিহারের চাকুলিয়ায় পূর্ণাঙ্গ ট্রেইনিং নিয়ে মুক্তযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আবদুল মালেক সোনা বলেন, কলারোয়ার বেলেডাঙ্গা, বৈকারি, ভাড়–খালি, কদমতলা, আবাদের হাটসহ বেশ কয়েকটি ছোট বড়যুদ্ধে আমি অংশ নিয়েছি। এসব যুদ্ধে জয়ী হয়েও যেনো মন ভরছিল না। তিনি বলেন সাতক্ষীরা শহরে আক্রমন করতে না পারলে যেনো যুদ্ধ জয়ের স্বাদই পাচ্ছিলাম না। আমাদের টীমে আবদুল্লাহ ছিলেন কমান্ডার। আর আমি ডেপুটি কমান্ডার। সাথে আরও ছিলেন গৌর চন্দ্র, আবদুল মান্নান, রফিক, হরিপদ, আশরাফ, অরুণ কুমার, কাজেম আলি ও কামরুজ্জামান বাবু। বাংলাদেশ সীমান্তের ঘোনায় ক্যাম্প করেছিলাম আমরা। লে. আহসান আমাদের চুড়ান্ত কমান্ড দিতেন। আমাদের প্রতিদিনের কাজ ছিল কোনো না কোনো অপারেশন করা। মালেক সোনা বলেন এ সময় শহরের অ্যাড. কালিপদ রায় চৌধুরীর ছেলে মলয় রায় চৌধুরী এসে বললেন, নবম সেক্টর অধিনায়ক মেজর জলিল শহর অপারেশনের জন্য তার কাছে দুটি টাইম বোমা দিয়েছেন। এতে সবাই পুলকিত হয়ে উঠলেন। কোথায় ব্যবহার করা হবে এই টাইমবোমা। তা নিয়ে চললো আলোচনা। অবশেষে সোনা বললেন ‘সাতক্ষীরা শহর অপারেশনের প্রধান বাধা বিদ্যুতের আলো। অতএব পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিতে হবে।’ আর এর দায়িত্ব পড়লো আবদুল্লাহ ও মালেক সোনার ওপর।

সময়টা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। শহরময় মিলিটারি আর রাজাকার। দিনে রাতে সব সময় সতর্ক পাহারা তাদের।এমন অবস্থায় ঘোনা থেকে রাতের আাঁধারে শহরে প্রবেশ করেন আবদুল্লাহ ও সোনা। তারা পাওয়ার হাউসের কাঁটাতারের বেড়া কাতারি (লোহার তার কাটার যন্ত্র)দিয়ে কেটে ফাঁকা করে রাত ১১ টার দিকে ঢুকে পড়েন ইঞ্জিন রুমে। আশপাশে তখন নিরাপত্তা প্রহরীরা ঝিমুচ্ছে। চারদিকে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। কাছেই ৮ টি জেনারেটর বসানো। এর নিচে ফাঁকা জায়গায় ডেটোনেটরের মুখ কেটে টু ব্যান্ডের রেডিও আকৃতির প্রতিটি ১২ পাউন্ডের বোমা দুটি চারমিনেটে বসিয়ে দেন তারা। এরপরই ডেটোনেটরে আগুন দেওয়া হয়।

সোনা বলেন আমরা দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শহরের অদুরে বাঁকালে পৌছাতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় বোমা দুটি। এর ফলে সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পূর্ন ধসে পড়ে। লন্ডভন্ড হয়ে যায় যন্ত্রপাতি। জীবন হানির ঘটনাও ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকাররা আতংকিত ও হতচকিত হয়ে পড়ে। তারা রাতভর টেনশনে কাটায়। পরদিন পাকিস্তানি সেনারা এসে পাওয়ার হাউসের হেড ক্লার্ক ও কয়েকজন নিরীহ কর্মচারিকে পিটিয়ে হত্যা করে। সোনা বলেন পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দেওয়ার মাত্র কিছুদিনের মাথায় সাতক্ষীরা থেকে শত্রুরা বিতাড়িত হয়। আর ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি মহান বিজয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক সোনার বয়স এখন ৭৮। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। নিজের বাড়ি ঘর নেই, থাকেন শ্বশুর বাড়িতে। দুই ছেলে তার বেকার। একমাত্র মেয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত। তার বিয়ে দিতে পারেন নি।

জীবনের এই প্রান্তে এসে এখন তিনি সব কষ্টের মধ্যেও স্বস্তি লাভ করেন পাওয়ার হাউস আক্রমন করে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার বীরত্বের কথা ভেবে। আরও শান্তি পান মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সূর্য জ¦ল জ¦ল করছে দেখে।