সাইফউদ্দিনের বলে সাঞ্জায়ার ক্যাচটা যখন বাতাসে ভাসল, তখনই সব শেষ! শেষ ম্যাচের, শেষ সিরিজের, শেষ মাশরাফির! টি-টুয়েন্টিতে সাইফুদ্দিনের প্রথম উইকেট হতে লঙ্কান ব্যাটসম্যানের ক্যাচ তখন মাহমুদউল্লাহর তালুতে, এই প্রথমের আড়ালেই শেষ মাশরাফির টি-টুয়েন্টি অধ্যায়ের। ৪৫ রানের জয়ে ছোট ফরম্যাট থেকে বিদায় টাইগার ক্রিকেটের মহানায়কের।
প্রথমে ছুঁটে এলেন মিরাজ। হাতটা ছোঁয়ার পর মাশরাফি এ ম্যাচেই অভিষিক্তকে বুকে টেনে নিলেন। মিরাজ যেন ছাড়তে চাইছিলেন না। ছাড়তে হলো। ততক্ষণে সকলে কাছাকাছি চলে এসেছে। আজ যে সবাইকে মাশরাফির বুকে জড়িয়ে যেতেই হবে। মিরাজ কয়েক সেকেন্ড পর আবারো ফিরে এলেন মাশরাফির কাছে। আবার জড়িয়ে গেলেন বুকে। এই বুকের ছায়া যে টি-টুয়েন্টির ময়দানে অন্তত আর মিলবে না, সেটি ততক্ষণে বোঝা হযে গেছে মিরাজের।
এরপর একে একে সকলকে বুকের স্পর্শ দিলেন মাশরাফি। এই বুক যে বাংলার বুক। যেখানে ধারণ করা আছে লাল-সবুজের পুরো মানচিত্রটা। এই মানচিত্রটা যারা এঁকেছেন, সেই মহান মুক্তিযোদ্ধারাই তার কাছে আসল নায়ক। গৌরবের সেই নায়কদের কাছে পেয়েছেন গর্জে ওঠার রসদটা। সেটাই ছড়িয়ে গেলেন লাল-সবুজের জার্সিতে। ধারণ করে গেলেন বুকে। সেই বুকের স্পর্শ তো আরাধ্য হবেই।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিরীহ হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়। লড়াইয়ের প্রাণান্ত চেষ্টা করে। আর মাশরাফি তো টাইগার। যার গর্জে ওঠার রেণু রক্তেই। মহানায়কদের রক্তে যেমন থাকে। তাদের গল্প শুধু ফিরে আসার। সেই ফিরে আসাটা শেখানোর দরকার ছিল একদল টাইগারকে, রেণুটা সবার রক্তে ছিলই; শুধু প্রাঞ্জল করে তোলার কোন জিয়ন কাঠির দরকার ছিল। মাশরাফি এলেন সেই জিয়ন কাঠি হয়ে। জাগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই।
বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। পাওয়া-না পাওয়ার মধ্য দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন ১৬টি বছর। টেস্টে ফেরার আশাটা ঠিক ছেড়ে দেননি। চোটের প্রভাব আর বর্তমানে বয়সটাই দুর্বার এই পথে সবচেয়ে অপ্রিয় ও কঠিন প্রতিপক্ষ মাশরাফির! সেটার স্বপ্ন জিইয়ে রেখেই ছেড়ে দিলেন টি-টুয়েন্টির ময়দান। এখন সামনে রইল কেবল ওয়ানডের যাত্রা।
কেবল হাঁটুতেই ছয়বার অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। শল্যবিদের ছুরির নিচে থেকে তবুও বারবার ফিরে এসেছেন অদম্য প্রত্যয়ী এ ক্রিকেটার। এখনো নিয়মিত ব্যথানাশকের আশ্রয় নিতে হয় মাশরাফিকে। হাঁটুতে লাগানো আছে কৃত্রিম একটা বাটি। যার তলায় জমতে থাকে অযাচিত রসকণিকা।
কিন্তু মাশরাফি দমে যাননি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে ফারাক তৈরি করতে চাওয়া সেই অযাচিত জমাট রসাল পদার্থগুলো সিরিঞ্জে নিংড়ে আবারো মাঠে নেমে পড়েছেন। দলকে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন বিশ্বসেরা হওয়ার। নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। তার নেতৃত্বে পরশপাথর হয়ে তেঁতে উঠেছেন প্রবল সম্ভাবনার পরও মুষড়ে যাওয়া একদল সহযোদ্ধা।
টি-টুয়েন্টিতে সেই পরশ পাথরকে আর মাঠে দেখা যাবে না। তবে তিনি থাকবেন। যতদিন ক্রিকেট থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। কেননা তিনি মাশরাফি। মহাকালই ঠিক করে রেখেছে তার স্থান। তাইতো মহাকাল তার বিদায়ের বিষাদের মলাটে তিলক এঁকে দিলো জয়োৎসবের প্রলেপে।