দেশের খবর: ব্যাংকে টাকা রেখে মুনাফা ঘরে তোলা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। নানা রকম সার্ভিস চার্জ আর করজালে গ্রাহকের মুনাফার একটি বড় অংশ চলে যায়। এতে সঞ্চয়ে নিরুৎসাহ হচ্ছে মানুষ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না আমানত। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি এক সার্কুলার জারি করে গ্রাহকের হিসাব সংরক্ষণ ফি কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঞ্চয়ী ও চলতি উভয় হিসাবে গ্রাহকের এই চার্জ কমানো হয়েছে। এতে প্রতিবছর গ্রাহকদের সাশ্রয় হবে প্রায় ৫২৮ কোটি টাকা, যা এত দিন ব্যাংকগুলোর পকেটে ঢুকত।
ওই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হওয়া নিয়ে অবশ্য শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ বেশির ভাগ ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী তাদের হিসাব সংরক্ষণ ফির তথ্যটি এখনো হালনাগাদ করেনি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নজরদারি অব্যাহত আছে। এ ছাড়া গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হিসাব সংরক্ষণের নতুন ফি নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে অযৌক্তিক চার্জ নিতে না পারে সে জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কঠোর অবস্থান।
ব্যাংকগুলো তাদের কোন সেবায় কত চার্জ নেবে, আর কোন সেবায় চার্জ আরোপ করতে পারবে না এ বিষয়ে সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করা হয়েছিল। ওই সার্কুলারে অন্যান্য সেবার মতো সঞ্চয় ও চলতি হিসাবে কত টাকা চার্জ নেওয়া যাবে সেটি নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় সব ধরনের সঞ্চয়ী হিসাবে প্রতি ছয় মাস অন্তর ৩০০ টাকা এবং চলতি হিসাবে ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ২০১০ সালের ১৩ মে আরেক সার্কুলারে সঞ্চয় হিসাবের পাঁচ হাজার টাকা গড় আমানত স্থিতির আমানতকারীদের ক্ষেত্রে হিসাব সংরক্ষণ চার্জ আদায় না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘদিন এই নিয়মেই হিসাব সংরক্ষণ ফি কেটে আসছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু গত ৩১ অক্টোবর গ্রাহকের হিসাব সংরক্ষণ ফি কমিয়ে আরেকটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত গড় আমানতকারীর হিসাব থেকে কোনো ফি আদায় করা যাবে না। আগে এ সীমা ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর ছয় মাস অন্তর ১০ হাজার এক টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত গড় আমানতের স্থিতির ক্ষেত্রে ১০০ টাকা, ২৫ হাজার এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ২০০ টাকা, দুই লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫০ টাকা এবং ১০ লাখ টাকার অধিক আমানতের ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা হিসাব সংরক্ষণ ফি আদায় করা যাবে। এ ছাড়া চলতি হিসাব পরিচালনা চার্জ ছয় মাস অন্তর ৩০০ টাকা আদায় করা যাবে। আগে ২৫ হাজারের অধিক যেকোনো পরিমাণ আমানত স্থিতির ক্ষেত্রে ছয় মাস অন্তর ৩০০ টাকা এবং চলতি হিসাবে ছয় মাস অন্তর ৫০০ টাকা করে আদায় করতে পারত ব্যাংকগুলো। এতে ব্যাংকগুলোর বছরে আয় হতো প্রায় এক হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু ফি নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে হবে এক হাজার ১২৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ফলে গ্রাহকের সাশ্রয় হবে ৫২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই আমানতকারীদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। তার মধ্যে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ বছরে দুইবার কাটা হচ্ছে। এর বাইরে আবগারি শুল্ক এবং উৎস করও কর্তন করা হয়। এত ব্যয় নির্বাহ করে প্রকৃতপক্ষে কোনো আমানতকারীই মুনাফা নিয়ে ফিরতে পারে না। এ জন্য আমরা আমানতকারীদের কথা চিন্তা করে হিসাব সংরক্ষণ ফি কমিয়েছি। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও আমানতকারীদের প্রকৃত আয় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
ব্যাংক হিসাব সংরক্ষণ ফি কমিয়ে নির্ধারণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে পাঁচ লাখ টাকার আমানতকারী গ্রাহক ছিলেন চার কোটি ৬৭ লাখ ২৩ হাজার ১৫০ জন। এসব গ্রাহক আগে থেকেই হিসাব সংরক্ষণ ফির বাইরে আছেন। ব্যাংকে পাঁচ লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারী আছেন ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৬৪৬ জন। নতুন নির্দেশনার ফলে এ শ্রেণির আমানতকারীদের হিসাব সংরক্ষণ ফি দিতে হবে না। এখানে সাশ্রয় হবে ৪৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২৫ লাখ এক টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা এক কোটি চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৬০। তাঁদের হিসাব সংরক্ষণ ফি ১০০ টাকা কমানোয় বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ২০৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। দুই লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীর সংখ্যা ৪৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৬। তাঁদের হিসাব সংরক্ষণ ফি ৫০ টাকা কমানোয় বছরে সাশ্রয় হবে ৪৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে ৫৫ লাখ ৮২ হাজার ১৪৬ জন গ্রাহকের চলতি হিসাব থেকে সংরক্ষণ ফি কাটতে পারে ব্যাংকগুলো। চলতি হিসাবে ফি ২০০ টাকা কমানোয় এখানে সাশ্রয় হবে আরো ২২৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে সঞ্চয়ী ও চলতি হিসাবের গ্রাহকদের বছরে ৫২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার মতো সাশ্রয় হবে। এর মধ্যে সঞ্চয়ী হিসাবের গ্রাহকদেরই সাশ্রয় হবে ৩০৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
আগামী ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক হলিডে। ওই দিন ব্যাংকগুলো পঞ্জিকা বছরের আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করবে। ফলে তখন বছরের দ্বিতীয় ছয় মাসের জন্য বিভিন্ন সেবার বিপরীতে নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ ও ফি কেটে নেবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী অনেক ব্যাংক তাদের হিসাব সংরক্ষণ ফির তথ্য হালনাগাদ না করায় গ্রাহকরা আতঙ্কে আছেন।