নিজস্ব প্রতিনিধি : স্বাস্থ্য সম্মত জাতি গঠনে বাল্য বিবাহরোধ জরুরি উল্লেখ করে সাতক্ষীরায় এক গোল টেবিল বৈঠকে বলা হয় বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার ৫৪ শতাংশ হলেও সাতক্ষীরায় এই হার ৭৪। বাল্য বিবাহের এই উচ্চ হার কমিয়ে সহনশীল অবস্থানে আনা দরকার। বাল্য বিবাহের কারণে সংশ্লিষ্ট মায়ের গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেয় তা খর্বাকৃতি,হাবাগোবা, অটিস্টিক, কম ওজন, প্রতিবন্ধী এমনকি পুষ্টিহীন হয়ে রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ে। বাল্য বিবাহ রোধ করতে না পারলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। সাতক্ষীরায় দারিদ্র্যের হার ৪৬ শতাংশ উল্লেখ করে আয়োজকরা আরও বলেন এর কারণ ও সমাধান চিহ্নিত করে সরকারি ও সামাজিকভাবে কাজ করতে হবে। মঙ্গলবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের শহিদ সম আলাউদ্দিন মিলনায়তনে বেসরকারি সংস্থা সুশীলনের ‘নবযাত্রা’ প্রকল্প আয়োজিত ‘১৮ এর আগে বিয়ে নয়’ শীর্ষক গোল টেবিল বৈঠকে এসব তথ্য উঠে আসে। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন সাতক্ষীরার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক হুসাইন শওকত। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ‘নবযাত্রা’র আশীষ কুমার হালদার। গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব এর সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমেদ বাপী, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সুভাষ চৌধুরী , প্রথম আলোর কল্যাণ ব্যানার্জি, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, জেলা পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট শাহনাজ পারভিন মিলি, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারন সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, যুবউন্নয়ন অধিদফতর কর্মকর্তা আবদুল কাদের, মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের ফাতেমা খাতুন, স্বদেশ পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত, নবযাত্রা প্রকল্পের মোছা. কামরুননাহার, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটির কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট সাকিবুর রহমান বাবল, আটুলিয়া ইউপির ছফুরননেসা গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সদস্য পাপিয়া ফারজানা প্রমূখ। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে কোনো বিয়ে হয় না বরং একটি মূল্যহীন ঘোষনা হয় উল্লেখ করে বক্তারা বলেন সরকার সেটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করলেও অনেক ক্ষেত্রে তা বোআইনিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে গোপনে বর কনেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বিয়ে দিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিয়ে বন্ধ না করা গেলে বাল্য বিবাহ পরবর্তী বর কনের ওপর ১৮ এর আগে সন্তান ধারন নয় এমন বিধিনিষেধ জারির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার তালিকা সংগ্রহ করে সমাজকে সচেতন করার আহবান জানিয়ে সব স্কুল প্রধানকে শিক্ষার্থীর বাল্য বিবাহের বিষয়ে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ ছাড়া কেবল মাত্র মেয়েদের নয় ছেলেদের নিয়ে সামাজিক বৈঠক করে তাদেরকে বাল্য বিবাহ থেকে সরিয়ে আনতে হবে বলেও উল্লেখ করেন বক্তারা। এমনকি পিতা মাতা বা অভিভাবকদের সাথেও বৈঠক করে বাল্য বিবাহর অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার আহবান জানান তারা। বৈঠকে বক্তারা বলেন গত তিন মাসে সাতক্ষীরা জেলায় কমপক্ষে ১০০ টি বাল্য বিবাহ সংঘটিত হয়েছে। অপর দিকে প্রশাসনের সহায়তায় দৃশ্যমানভাবে বন্ধ করা গেছে ছয়টি বাল্য বিবাহ। ‘নবযাত্রা’র আয়োজকরা বলেন গত দুই বছরে তারা কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৮৬ টি বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছিলেন। অথচ এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বিয়ে গোপনে সম্পন্ন হয়েছে। জনগনের মাঝে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। একই সাথে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বিয়েতে জন্ম নিবন্ধনের নিশ্চিত ব্যবহার এবং ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা ও জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ বিষয়ক জরিপ সমন্বয় করা দরকার। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক ধ্যান ধারনার জায়গায় কুঠারাঘাত করতে হবে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন কেবলমাত্র আইনের বেড়াজাল দিয়ে এই প্রবণতা রোধ করা দুস্কর। সমাজ থেকে যৌক্তিক কারণ ছাড়া বহু বিবাহ বন্ধ করতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাল্য বিবাহরোধে নিয়মিত শিক্ষামূলক কমসূচি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় বৈঠকে। মসজিদে, মন্দিরে, মাদ্রাসায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে তাদের জানাতে হবে বাল্য বিবাহ পড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিটি এলাকায় কোনো বিয়ের আগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অথবা পৌরসভার মেয়রের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। সমাজ থেকে দারিদ্র্য দুর করতে না পারলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কঠিন বলেও উল্লেখ করেন আলোচকরা। এ প্রসঙ্গে বিদ্যালয়ে লাল কার্ড দিয়ে বাল্য বিবাহ বিরোধী জাগরন সৃষ্টি, প্রতিরোধ কমিটিগুলিকে আরও শক্তিশালী করা এবং বাল্য বিবাহ বন্ধে পুরস্কার আর বাল্য বিবাহ হলে তিরস্কার ও শাস্তির বিধান থাকা দরকার। বাল্য বিবাহের শিকার মেয়েরা সামাজিকভাবে নানা অপঘাতের মুখে পড়ে। পরে তারা পাচারের শিকার হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে নারীদের ও অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। বয়স সক্ষমতা ভেদে তাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে অথবা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বাল্য বিবাহের শিকার হয়ে নানা ধরনের সামাজিক যন্ত্রণায় ভুগছেন তাদেরকে সামনে নিয়ে এনে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে হবে। ভুয়া বিয়ে পড়ালে তাকে সাজা দিতে হবে। গোল টেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক হুসাইন শওকত বলেন বাল্য বিবাহরোধে সবগুলি অনুসঙ্গ নিয়ে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন সামাজিক দারিদ্র বিমোচন যেমন জরুরি, তেমনি সামাজিক বৈষম্য, বিশেষ করে জেন্ডার বৈষম্য দুর করতে কর্মসূচি নিতে হবে। জন্ম নিবন্ধন সঠিক হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন ১৮২৯ সালের বাল্য বিবাহ আইন ২০১৭ সালের পরিবর্তিত ও সংশোধিত আইনে উন্নীত হলেও বর্তমান প্রচলিত আইনেও সাজা দেওয়া যাচ্ছে না। তবে সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগে সাজা কার্যকর করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাল্য বিবাহ যদি হয়েই যায় সে ক্ষেত্রে নব দম্পতিকে যাতে ১৮ এর আগে সন্তান ধারন নয় এমন বাধ্যবাধকতায় আনা যায় তবে তা ফলপ্রসূ উদ্যোগ হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন বাল্য বিবাহরোধে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। তিনি বিয়ের ক্ষেত্রে অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করে হুসাইন শওকত আরও বলেন সাতক্ষীরা এলাকায় বাল্য বিবাহের হার ৮৯ শতাংশ থেকে কিভাবে ৭৪ শতাংশে নেমে এলো তা অনুসন্ধান করে সেই কর্মসূচিকে আরও বেগবান করতে হবে। গোল টেবিল বৈঠকে নবযাত্রা প্রকল্প পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানিয়েছে তারা গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সেবা, পুষ্টি সেবা, নয় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, কৃষি সেবাসহ নানা অনুসঙ্গে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে তারা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান করছেন বলেও উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন বাল্য বিবাহ নিরসনে নবযাত্রা প্রকল্প সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের চার লাখ নারীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে। আরও দুই বছর এই প্রকল্প কাজ করে যাবে বলে বৈঠকে জানানো হয়।