শিক্ষাঙ্গনের খবর: শিবির সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক চার শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে আটকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) রাতে এ ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের পর আহত শিক্ষার্থীদের রাত আনুমানিক ২টার দিকে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের হস্তক্ষেপে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। পরে পুলিশ আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়।
আহত শিক্ষার্থীরা হলেন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুকিম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানওয়ার হোসেন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দীন ও একই বর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আফসার উদ্দীন।
তবে ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করেছেন, ওই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিবির সংশ্লিষ্ট বই উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু তারা উদ্ধারকৃত বইয়ের নাম বা কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।
হল সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার চার শিক্ষার্থী হল ছাত্রলীগের হস্তক্ষেপে হলে উঠেছিলেন। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা হল শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজার গ্রুপের মাধ্যমে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। তারা নিয়মিত রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়েও অংশ নিতেন। এখন তাদের ‘শিবির ব্লেম’ দিয়ে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন ছাত্রলীগের নেতারাই।
এছাড়াও হল ছাত্র সংসদের ভিপি সাইফুল্লাহ আব্বাছী এবং জিএস তোফিকুল ইসলাম ও এজিএস সুরাপ মিয়া সোহাগও শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এক শিক্ষার্থী বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘হল সংসদের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করা। তবে কোনও তথ্য প্রমাণ ছাড়া শিক্ষার্থীকে শিবির ব্লেম দিয়ে মারধর করা সত্যি খুব দুঃখজনক ঘটনা।’ তিনি বিষয়টির তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু সমাধানের দাবি জানান।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, রাত আনুমানিক সাড়ে ১১ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. মুকিম চৌধুরীকে গেস্টরুমে ডাকা হয়। সেখানে তাকে শিবির করে কি-না, তা জিজ্ঞাসা করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। পরে ওই শিক্ষার্থী বিষয়টি অস্বীকার করলে শিবির করার অভিযোগ তুলে তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম হলেও ওই শিক্ষার্থী শিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার না করায় এক পর্যায়ে তাকে মারধর শুরু করেন ছাত্রলীগ নেতারা। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ফোন নিয়ে নেন এবং মেসেঞ্জারে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আদান-প্রদান হওয়া বার্তা চেক করেন। পরে মেসেঞ্জারের সূত্র ধরে মুকিমের তিন বন্ধুকে গেস্টরুমে ডেকে আনা হয়। এসময় হল সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) সাইফুল্লাহ আব্বাসী অনন্তসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের নেতারা এসে রড, লাঠি দিয়ে তাদের মারধর করে। মারধরে গুরুতর আহত হন তারা।
মারধরের বিষয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আমির হামজার কাছে জানতে একাধিকবার ফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তবে তিনি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, ওই শিক্ষার্থীদের মারধর করেননি। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে শিবিরের দুটি বই উদ্ধারের কথা বললেও তিনি উদ্ধার হওয়া বই বা এ বিষয়ে কোনও প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেননি।
কথা বলতে চাইলে জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেনের ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে জহুরুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) সাইফুল্লাহ আব্বাছীকে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়নি। শিবিরের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গলে হল প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়। শিক্ষার্থীদের মারধর না করলে, তাদের হাসাপাতালে চিকিৎসার জন্য কেন পুলিশ নিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মারধরের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। এ বিষয়ে কিছু জানি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘মারধর করে আইন হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। বিষয়টি ভালো হয়নি। তবে কেউ যদি শিবিরের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে হল প্রশাসন রয়েছে, তাদের বিষয়টি অবহিত করাই ছিল মূল কাজ।’
এ বিষয়ে জানতে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনকে ফোন দিলে তিনি মিটিংয়ে রয়েছেন বলে ফোন কেটে দেন।
তবে, আবাসিক শিক্ষক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অভিযোগ উঠলে আমরা কর্তৃপক্ষ তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। মারধরের বিষয়ে কোনও লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি, পেলে বিষয়টি দেখা হবে।’
শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তারা যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে মারধরের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, গতকাল রাত আনুমানিক তিনটার দিকে হল থেকে চার শিক্ষার্থীকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি।