দেশের খবর: প্রশাসনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি-অন সার্ভিস ডিউটি) প্রশ্নে কোনো বদনাম নিতে চায় না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এজন্য এ বিষয়ে ইতিবাচক পথে হাঁটছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল। অতীতে একসময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে টার্গেটকৃত কর্মকর্তাদের বিপুল সংখ্যায় ওএসডি করে ফেলে রাখার রেকর্ড সৃষ্টি হলেও বর্তমানে সেটি একেবারে নেই বললেই চলে। বেদনাদায়ক সংখ্যাটি গত সপ্তাহে দুই অংকে নেমে এসেছে। যার সংখ্যা মাত্র ১১-১২ জন হবে। সূত্রমতে, যেটি চলতি সপ্তাহে শূন্যের ঘরে নেমে আসতে পারে। এমনটিই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র বলছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন ধাপে ওএসডিকৃত কর্মকর্তার সংখ্যা বর্তমানে কমবেশি ২৯০ জন হলেও সমালোচনা করার মতো ওএসডি তকমা এখন বিদায়ের পথে। সাধারণত যেসব কারণে কর্মকর্তাদের ওএসডি করার প্রয়োজন পড়ে, এই পরিসংখ্যানটি সেই তালিকাভুক্ত। উপরোন্তু, নীতিনির্ধারক মহলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে কাউকে ওএসডি করার ক্ষেত্রে অধিকতর যাচাই বাছাই করা হবে। কেউ স্বেচ্ছায় ওএসডি আছেন কিনা সে ব্যাপারেও খোঁজ নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি সুদক্ষ ও মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে আমরা সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেখানে ওএসডি নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনার কোনো সুযোগই থাকবে না। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি থেকে শুরু করে এ মন্ত্রণালয়ের সব কিছু নিয়মনীতি ও বাস্তবতার নিরিখে হবে। তিনি বলেন, দেশপ্রেম আমাদের মূলমন্ত্র। পাশাপাশি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সেবা দিতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেবার মানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যাতে সবসময় সামনের কাতারে এগিয়ে থাকে, সেজন্য আমাদের প্রতিমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এ বিষয়ে উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাবে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ২৯০ জন কর্মকর্তা ওএসডি থাকার কথা বলা হয়। এর আগে এ সংক্রান্ত এক রিটের রায়ে ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট কোনো কর্মকর্তাকে ১৫০ দিনের বেশি ওএসডি না রাখার আদেশ দেন। যদিও ১৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন।
এদিকে উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। পুরো ওএসডি তালিকা পর্যালোচনা করে বিদ্যমান সংখ্যা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটি ভাবা হচ্ছে। যদিও ওএসডি তালিকার ২৯০ জনের বেশির ভাগ আছেন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ছুটিতে। এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য ১৬৭ জন, লিয়েনে ২১ জন, বিভাগীয় মামলা, অসুস্থতা ও পিআরএলজনিত কারণে ৬৯ জন, প্রশিক্ষণের কাজে ১০ জন, তিন মাসের বেশি ছুটি নেয়ায় তিনজনকে এবং প্রশাসনিক কারণ ও জনস্বার্থে ২০ জনকে ওএসডি করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মূলত রাজনৈতিক কারণে যে ধরনের ওএসডি করার অভিযোগ থাকে তার সংখ্যা বর্তমানে বড় জোর ১০-১২ জন। তাদেরও এখন পোস্টিং দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে পোস্টিং দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মূলত প্রশাসনে ৯টি কারণে কর্মকর্তাদের ওএসডি করতে হয়। যেমন- এক. অবসরে যাওয়ার পূর্বে প্রেষণে থাকলে ওএসডি করা হয়, দুই. কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ার পর পরবর্তী পদায়নের আগে ওএসডি করতে হয়, তিন. উচ্চশিক্ষা ও লিয়েনের জন্য, চার. তিন মাসের বেশি কেউ ছুটি নিলে, পাঁচ. এনডিসি কোর্সের জন্য, ছয়. বিভাগীয় মামলা ও গুরুতর অসুস্থতার কারণে, সাত. জনপ্রশাসন থেকে অবসর নিতে চাইলে, আট. সংযুক্তি থেকে অবসর দিতে গেলে এবং নয়. জনস্বার্থ ও প্রশাসনিক কারণে ওএসডি করা হয়। মূলত শেষক্তো কারণটি ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। যেটি বর্তমান সরকারের আমলে নতুন করে এখন আর কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, একজন কর্মকর্তাকে অহেতুক ওএসডি করে ফেলে রাখলে প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়। এছাড়া কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও তার দক্ষতা কমতে থাকে। মূলত সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ওএসডি শব্দটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। বিষয়টি নিয়ে শোধ প্রতিশোধ এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে ওএসডিকৃত কর্মকর্তার সংখ্যা স্মরণকালের রেকর্ড সৃষ্টি করে। বিষয়টি নিয়ে সাবেক সিএসপি সচিব এম আসাফ উদ দৌলা ২০১২ সালে আদালতে রিট করেন। প্রায় ৮ বছর পর যার রায় হয় গত ৮ জানুয়ারি। এই রায়কে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আদালতে ৯ বছরের একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বছর ১৩ মে জমা দেয়া প্রতিবেদনের সারমর্ম অনুযায়ী ওই তারিখ পর্যন্ত প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তিন হাজার ৬০৫ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তাদের পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ১৫০ কোটি ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ৭ টাকা। রিটের শুনানিকালে বলা হয়, ১৯৯১ সালের ৩ অক্টোবর তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) এক প্রজ্ঞাপন মোতাবেক সর্বনিম্ন ৪৫ এবং সর্বোচ্চ ১৫০ জনকে ওএসডি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেটি বারবার অমান্য করা হয়েছে।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, সিভিল সার্ভিসে যখন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাম দিয়ে ওএসডি করার নিয়ম শুরু হয়, তখন সেটি ছিল খুবই মর্যাদাকর। কেননা, প্রশাসনের খুবই দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হতো। কিন্তু অনেক পরে যখন এর অপব্যবহার শুরু হয়, তখন ওএসডি নেতিবাচক শব্দে পরিণত হয়। যদিও সেই শুরুর দিককার কথা বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত করতে দু’মাস আগে কয়েকজন চৌকস কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।