নিজস্ব প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরতন ভবন নিলাম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে উপজেলা টেন্ডার কমিটি একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন নিলামের জন্য গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যালয়ের ভবন প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে সদস্য করে চার সদস্য বিশিষ্ঠ কমিটি গঠণ করা হয়। নিলামের জন্য গত ১৭ জানুয়ারি দৈনিক যুগের বার্তা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। ১৩০টি দরপত্র বিক্রি করা হয়। উপজেলা নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২২ জানুয়ারি নিলাম প্রক্রিয়া শেষে পরদিন নিলাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুন্নাহার স্বাক্ষরিত সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ২৬ জন নিলাম গ্রহীতাদের তালিকা নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মোট নিলামের টাকা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৮ হাজার ৩০০ টাকা। নিলামে সর্বোচ্চ ডাককৃত মূল্যের উপর ১০ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ আয়করের টাকা সোনালী ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে তিন কার্র্যদিবসের মধ্যে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস থেকে কার্যাদেশ গ্রহণের জন্য বলা হয়। পুরাতন ভবন ক্রেতা কালীগঞ্জের চরদা গ্রামের আল মামুন, সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়ার মাসুদুর রহমান, হাসান, সুলতানপুরের কর্ণেল বাবু, ও ভাঙড়ি মিঠু ও পলাশপোলের আবুল হোসেন জানান, কালীগঞ্জের ২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন নিলামে যুগের বার্তায় যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় তা কালীগঞ্জের একটি সিন্ডিকেডের কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। জানলে জেলার বেশ কয়েকজন পুরাতন ভবন ক্রেতারা দরপত্র কিনতে পারতো। সেক্ষেত্রে ১৩০টির পরিবর্তে ৮০০ থেকে এক হাজার দরপত্র বিক্রি হতো। প্রতিটি ২০০ টাকা করে দেড় থেকে দু’ লাখ টাকার দরপত্র বিক্রি হতো। দূর্ণীতির মাধ্যমে এ দরপত্র আহবান করায় সরকার এ থেকে দেড় লাখ বা পৌনে দু’ লাখ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। তারা আরো জানান, পানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে পুরাতন ভবন তা ভ্যাট বাদে নিলাম দেখানো হয়েছে ৩৭ হাজার টাকায়। স্বচ্ছতার মাধ্যমে নিলাম হলে ওই ভবনের ৩০ হাজার ভাল ইট , দু’ টন লোহার রড ও বিপুল পরিমান রাবিশ মিলতো। সেক্ষেত্রে প্রতি হাজার ইট ৫ হাজার টাকা করে দেড় লাখ, ২০ টাকা কেজি দরে দু’ টন লোহার রড চার লাখ টাকা ও ৩৫ হাজার টাকার রাবিশ বিক্রি হতো। অর্থাৎ সরকারের সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার রাজস্ব লুটপাট করা হয়েছে। একইভাবে মহৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন নিলাম দেখানো হয়েছে ১৯ হাজার ৩০০ টাকায়। এ ভবনে ২০ হাজার ভাল ইট ও দেড় টনের বেশি পুরাতন রড ছাড়াও ২০ হাজার টাকার রাবিশ মিলত। মালামালা বিক্রি হতো চাল লাখ ২০ হাজার টাকায়। সেক্ষেত্রে টেন্ডার কমিটি সিন্ডিকেট করে চার লাখ টাকা লুটপাট করেছে। একইভাবে চাঁচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন ১৩ হাজার টাকায় নিলাম বিক্রি হয়েছে। যা’ ভাঙার পর কমপক্ষে ১৫ হাজার ভাল ইট, এক টন রড ও ১৫ হাজার টাকার মত রাবিশ মিলবে। নিলাম কমিটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পৌনে তিন লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ২৬ টি বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন নিলাম করে নিলাম কমিটি ও একটি বিশেষ সিন্ডিকেট কোটি টাকা লুটপাট করেছে। স্থানীয়রা জানান, ২৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরাতন ভবনের দর নির্ধারণের জন্য উপজেলা উপসহকারি প্রকৌশলী সামসুল আলম উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রতিটি ভবন যথেষ্ট কম দর নির্ধারণ করেছেন। এ ছাড়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুন্নাহার উপজেলা চেয়ারম্যানের দক্ষিণহস্ত বলে পরিচিত সাজিদুল হক সাজুর মাধ্যমে দৈনিক যুগের বার্তা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দু’ চারটি ছাড়া প্রকাশিত সকল পত্রিকা গোপন করে বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে প্রচার হতে দেননি। সেক্ষেত্রে সাজু একাই ১৩০টি দরপত্র কিনে তাদের কাছের লোক কেরামত আলী, নাসিরউদ্দিন, শিমুল হোসেন, আতিকুর রহমান ও রাজু আহম্মেদের নামে জমা দিয়েছেন। সাজুর সহায়তায় কেরামত আলী ১০, নাসিরউদ্দিন ৮, শিমুল হোসেন তিন, আতিকুর রহমান তিনও রাজু আহম্মেদ দু’টি ভবন নিলাম কিনেছেন। ২৬টি ভবন ভাঙার জন্য শীতলপুরের আলাউদ্দিন চার লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এমনকি সোনালী ব্যাংকে ১০ শতাংশ রাজস্ব ও দু’ শতাংশ আয়কর জমা না দিয়েই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আলাউদ্দিনকে দিয়ে ২৪ জানুয়ারি থেকে পানিয়া, মহৎপুর ও চাঁচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবন ভাঙার কাজ শুরু করা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যানের বোন নিলাম কমিটির সদস্য পানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পারভিন আক্তার খুকুর কাছে সোমবার বিকেলে ভবন নিলামের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আপনাদের কাছে কোন জবাব দেবনা। তবে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মশিয়ার রহমান বলেন, তাদেরকে না জানিয়ে এ দর নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের ভবনটি কমপক্ষে সাড়ে চার লাখ টাকায় বিক্রি হতো। শুক্রবার থেকে ভবন ভাঙা হচ্ছে। মহৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা জামান বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। যা’ জানে টিইও ম্যাডাম। তবে ওই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খাঁন আহছানুর রহমান বলেন, এ যে পুকুর চুরি। পারলে নিলাম বন্ধ করার জন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, শুক্রবার থেকে ভবন ভাঙা হচ্ছে। একইভাবে চাঁচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, মাত্র ১৩ হাজার টাকায় ভবন বিক্রি। এ ভবনের দাম তো কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। শনিবার থেকে ভবন ভাঙা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক তাকে কিছু জানায়নি। তবে প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে পানিয়া ও মহৎপুর বিদ্যালয়ের ভবন নিলাম ক্রেতা কেরামত আলী মোবাইলে সাংবাদিক পরিচয় জেনে বলেন তিনি নয়টি ভবন পেয়েছেন। এরপরপরই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কথা বলতে চাননি চাঁচাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নিলাম ক্রেতা নাসিরউদ্দিন। তবে নিলাম ক্রেতা শিমুল হোসেন ও আতিকুর রহমান বলেন, তারা কিছুই জানেন না। সাজু যেখানে সই করতে বলেছে তারা সেখানে সই করেছেন মাত্র। তবে সোমবার বিকেলে সাজিদুল হক সাজুর সঙ্গে তার মোবাইলে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি তা রিসিভ করেননি। কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈতদ মেহেদী বলেন বিষয়টি তিনি রোববার শুনেছেন। সব প্রতিষ্ঠানের ইট ও রড ভাল নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করবেন সংশ্লিষ্টদের সাথে। তবে তিনি কোন অনিয়মের সঙ্গেযুক্ত নন বলে দাবি করেন। কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উপসহকারি প্রকৌশলী সামছুল আলম তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সহকারিদের পাঠিয়ে ভবনগুলোর দর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হতে পারে। বাকী কাজ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার। উপজেলা প্রকৌশলী জাকির হোসেন বলেন, দু’ একটি ভবনের দাম নির্ধারণে ভুল হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে এটা বলা যাবে না। নিলাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সামছুন্নাহার তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত কোন নিলাম গ্রহীতা ভ্যাট ও আয়করের কাগজপত্র তার দপ্তরে জমা দেয়নি। সোমবার একজন জমা দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে ২৪ জানুয়ারি থেকে ভবন ভাঙার কাজ শুরু করাটা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, ওয়ার্ক ওয়ার্ডার, দরপত্র বিক্রয়সহ সব কিছুই হয়েছে নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক রাসেল সোমবার বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি, দরপত্র বিক্রি, ভবনের দাম নির্ধারণ, ভ্যাট ও আয়করের কাগজ জমা দেওয়ার আগে ভাঙার কাজ শুরু ও বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিলাম বিক্রির বিষয়টি তিনি জানেন না। বিষয়টি জানানোর জন্য তিনি এ প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ঢাকায় প্রশিক্ষণ শেষে কালীগঞ্জে ফিরে ব্যবস্থা নেবেন।