সাহিত্য

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরীর গল্প ‘নিতাই স্যার ও ঘোল’

By Daily Satkhira

February 24, 2020

হঠাৎ সিট থেকে লাফিয়ে উঠে ভোটে জেতা নেতার মতো দুই হাত উঁচিয়ে নিতাই স্যার সোল্লাসে বললেন, ‘অ্যাই রোকো রোকো! সব ব্যাটাকে ঘোল খাওয়াব।’

কী না কী হয়েছে ভেবে ড্রাইভার সজোরে ব্রেক কষল।

কেরুর হাত থেকে গজা পড়ে গেল।…তা যাক!

বিপত্তি ঘটল হেড স্যারের। তিনি ঝিমুচ্ছিলেন। মাথাটা জবেহ করা মুরগির মাথার মতো নেতিয়ে ছিল। বাসের হঠাত্ গতি পতনে সামনের ছিটে হুমড়ি খেয়ে বেজায় নাকঘষা খেলেন। খেঁচমেচিয়ে উঠে নাক ডলতে ডলতে বললেন, ‘আহা! ড্রাইভার কী হলো?’

ড্রাইভারের চুলগুলো এমনিই খাড়া। ভয়ে আরো খাড়া হয়ে গেল। উদ্ভ্রান্তভাবে পেছন ফিরে নিতাই স্যারের দিকে বড় বড় চোখে তাকাল। বোঝাল—তার কোনো দোষ নেই, যত দোষ ওই নিতাই স্যারের।

হেড স্যার লালচে নাকে রোবটের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে নিতাই স্যারের ওপর দৃষ্টিবোমা ফেললেন।

‘কী ব্যাপার নিতাই বাবু! খেঁকশিয়ালের মতো অমন খেঁকিয়ে ওঠার মানে কী?’

নিতাই স্যার কাঁচুমাচু করে দুই হাত কচলে বললেন, ‘স্যার! পুরো দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে এই জায়গাটিতেই অত ভালো ঘোল বিক্রি হয়। খাঁটি ও খাসা। পেটের সাতচল্লিশ রকম রোগ ভালো হয়।…’

‘তাই নাকি!’ মাঝখান থেকে সাগ্রহে জিজ্ঞস করলেন গ্যাস্ট্রিকের রোগী ভূগোল স্যার।

‘আপনি থামুন তো!’ মুখ খিঁচিয়ে ভূগোল স্যারকে থামালেন হেড স্যার।

…‘তাতে হয়েছেটা কী?’

নিতাই স্যার মাথা সোজা করে বললেন, ‘ঘোল খাওয়ানোর সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলাম স্যার! টাকা-পয়সা সঙ্গে এনেছি, কিন্তু মনে ছিল না। জায়গাটা পার হয়ে যাচ্ছি দেখে তাড়াতাড়ি থামাতে গিয়ে…’—বলেই নিতাই স্যার সবার দিকে একপাক চোখ ঘোরালেন, ‘অ্যাই, তোমরা নাবছ না কেন? নাবো নাবো! ঘোল খাবে, নাবো!’

ছেলে-মেয়েরা মহানন্দে-আনন্দে হুড়মুড়িয়ে বাস থেকে নাবতে লাগল। তাই দেখে হেড স্যারের কুঁচকানো কপালটাও নতুন কাগজের মতো সমান হয়ে গেল; মানে—ঘোলের লোভে রাগ জল হয়ে গেল। সেই পাঁচ বছর বয়সে একবার ঘোল খেয়েছিলেন; তারপর সুদীর্ঘ ৫৫ বছরে জোটেনি আর। কচ্ছপের মতো থপথপিয়ে বাস থেকে নামলেন।

জায়গাটা মুন্সীগঞ্জের কাছেই। নাম-মুনছুর সরদারের গ্যারেজ। গ্যারেজ বলতে কিছুই নেই। ধু ধু বিল। তার মধ্যে কালো ফিতার মতো একটানা চলে যাওয়া পাকা রাস্তাটার পাশে এক জায়গায় কতগুলো শিরীষগাছ। তলায় তক্তার বেঞ্চিতে বড় বড় হাঁড়ি রাখা, সবগুলো ঘোলের। টেকো মাথার গোপাল ভাঁড় মার্কা একজন আছেন, তিনি ঘোলওয়ালা।

জায়গাটিতে সুন্দরবনের নিঃশ্বাস পড়ে। দক্ষিণ দিকে তাকালেই শান্ত বনের প্রান্ত দেখা যায়।

মুন্সীগঞ্জে পিকনিকে যাচ্ছে দক্ষিণ শ্রীপুর হাই স্কুল। মুন্সীগঞ্জ নামে একটি জেলা থাকলেও এটা কিন্তু সুন্দরবনের কাছের একটি জায়গা। মুন্সীগঞ্জ আর সুন্দরবন, মাঝে ছোট্ট একটা নদী। তাই পিকনিকও হবে, আবার সুন্দরবনও দেখা হবে। রোদ ঝলমলে আবহাওয়া। খুব সকালে সাতক্ষীরা থেকে রওনা হয়েছে তারা। দক্ষিণমুখো সোজা-সাপ্টা রাস্তা। একেবারে শেষ স্টপেজই মুন্সীগঞ্জ।

ষাট-সত্তরজনের একটা ভিড় জমে গেল। নিরিবিলি জায়গাটা হঠাত্ নানা কণ্ঠের চিত্কার-চেঁচামেচিতে গম গম করে ওঠল। কেরু এর-ওর ফাঁক দিয়ে ঘোলওয়ালার দিকে খালি গ্লাস বাড়াচ্ছে। এবার নিতে পারলে ছয় গ্লাস হবে। ভূগোল স্যার গ্লাসের বদলে জগ নিয়েছেন। দশ গ্লাসে এক জগ, আগেই জেনে নিয়েছেন।

হেড স্যার পঞ্চমবারের মতো গ্লাস নিলেন। ভিড় থেকে এক পাশে সরে এসে এক চুমুকেই অর্ধেকটা সাবাড় করলেন। গোঁফে ঘোলের সাদা দাগ লেগে আছে। এই ফাঁকে অঙ্ক স্যার হনহনিয়ে এসে হেড স্যারের কানে কানে বললেন, ‘যা-ই বলুন না স্যার, নিতাই বাবুর কথাটা কিন্তু ভালো শোনায়নি!’

‘কোন কথাটা?’

“ওই যে ‘সব ব্যাটাকে ঘোল খাওয়াব’।”

ভ্রু ঝাড়া দিয়ে ‘ওওওও’ বলে হেড স্যার আরেক চুমুকে বাকিটুকু সাবাড় করে বললেন, ‘বাদ দিন! নিতাই বাবু একটু আমুদে, তা তো সবাই জানেন—হেহেহে!’

রাসেলকে যেতে দেখে অঙ্ক স্যার খালি গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘অ্যাই! আরেক গ্লাস আন তো!’

বিজ্ঞান স্যার বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে দূরে সুন্দরবনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।

ধর্ম স্যার বললেন, ‘কী মনোরম দৃশ্য দেখেছেন!’

বিজ্ঞান স্যার গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমি শুধু বন দেখছি না, ভাবছি। ১০ হাজার বছর আগে এ জায়গাটা কিন্তু এমন ছিল না, সমুদ্র ছিল, এইচ বি মেদলিকোটের বই থেকে জেনেছি।’

‘আরে ভাই! মেদলিকোট তো সেদিনের লোক, আল-বিরুনি সাহেব হাজার বছর আগে এখানে সমুদ্র থাকার কথা আন্দাজ করে গেছেন।’

‘আরে ভাই! সে তো ১.৭ বিলিয়ন বছর আগে পুরো ভারত ভূখণ্ডই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল, আমি সে কথায় যাচ্ছি নে…’

বাংলা স্যার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়ালেন, ‘মেদলিকোটের কথা হচ্ছিল যেন!…তা এ ম্যানুয়েল অব দ্য জিওলজি অব ইন্ডিয়ার কথা হচ্ছিল তো?’

‘জি।’ বললেন বিজ্ঞান স্যার।

বাংলা স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘তা মেদলিকোট সাহেব কিন্তু একা ওই বইটা লেখেননি, আরেকজন ছিল, তাঁর নাম ব্লানফোর্ড, মজার ব্যাপার হলো—আমি যেবার প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যাই, আমার শ্বশুর ঠিক ওই বইটিই গিফট করেছিলেন।’…

‘আরে সব সময় শ্বশুরবাড়ি শ্বশুরবাড়ি করেন কেন?…চলুন! দেরি হয়ে যাচ্ছে!’ হেড স্যার এসে তাড়া লাগালেন।

৭০ জনে ৬৩৭ গ্লাস ঘোল খেয়ে গাড়িতে উঠলেন।

নদীর পারে বিজিবি ক্যাম্পে রান্নার জিনিসপত্র নামানো হলো। রান্না শেষ হতে সময় লাগবে। ততক্ষণে ছেলে-মেয়েরা সুন্দরবন দেখতে যাবে, ট্রলার ভাড়া করার তোড়জোড় চলছে। হেড স্যার ট্রলারঘাটে গিয়ে সব ব্যবস্থা খতিয়ে দেখছেন। এমন সময় কাঁদতে কাঁদতে সেখানে ছুটে এলো হেড বাবুর্চি।

‘স্যার, হাঁড়ি পুড়ে গেছে!’

‘এখনো রান্নাই চাপেনি, হাঁড়ি পুড়ল কী করে?…ইয়ার্কি পেয়েছ?’ হেড স্যার পাত্তাই দিলেন না।

কান্না থেমে গেল বাবুর্চির, ‘স্যার, আমি লোকাল ভাষায় বলেছি বলে আপনি বুঝতে পারেননি (ওই এলাকায় ‘পড়ে যাওয়া’কে ‘পুড়ে যাওয়া’, ‘বসে থাকা’কে ‘বুসে থাকা’ বলে উচ্চারণ করে স্থানীয়রা), আমার এই গাঁটিতে যেমন পানের কৌটো নেই, গাড়ির ছাদে তেমন হাঁড়িও নেই! হারামজাদা ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষায় পড়ে গেছে!’

হেড স্যার তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন, ‘ছেলেপিলে না খেয়ে থাকবে নাকি? গার্জিয়ানদের হাতে-পায়ে ধরে চাঁদা নেওয়া হয়েছে!’ হেড স্যার চুল ছিঁড়তে যাচ্ছিলেন, ‘ভাড়া করো! যাও! ভাড়া করো!’

‘সে পথ মেরে এসেছি স্যার, কাজ হয়নি, দুটো মোটে হোটেল আছে, রাইস কুকার সাইজের হাঁড়ি; খদ্দেরপাতি হয় না তো তাই, একটা মোটে ডেকোরেটরের দোকান, সেখানে বাঁশ-খুঁটি আর ইলেকট্রিক তার ছাড়া কিছু নেই!’

‘ভ্যান নিয়ে রাস্তায় যাও! যেখানে ব্রেক কষেছিল খুঁজে এসো!’

‘ও পথও শেষ স্যার, ধু ধু রাস্তা ছাড়া কিছু নেই!’

হেড স্যার এবার চুল ছিঁড়ছেন, ‘নিতাই বাবুকে ডাকো শিগগির!’

এর মধ্যে অঙ্ক স্যার চিত্কার ছেড়ে জগাই-মাধাই কায়দায় দুহাত বাড়িয়ে ‘আমার হাঁড়ি আমার হাঁড়ি’ বলতে বলতে ছুটে আসছেন, ‘চারটে হাঁড়ি চার দুনো আট হাজার টাকা! আমার কী হবে স্যার!’

অঙ্ক স্যারের ডেকোরেটরের ব্যবসা রয়েছে। তাঁর দোকান থেকেই হাঁড়ি-পাতিল ভাড়া করা হয়েছিল।

হেড স্যার ধমক দিলেন, ‘আহ সিরাজ সাহেব! আপনার হাঁড়ি গেছে, আমার যে চাকরিটাই যাবে! চুপ করুন তো! পরে দেখা যাবে!…যান! নিতাই বাবুকে ডাকুন!’

অঙ্ক স্যার কাঁদো কাঁদো মুখে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।

নিতাই স্যার একটা কেওড়াগাছের তলায় দাঁড়িয়ে কোক খাচ্ছিলেন। সামনে তিন-চারটি ছেলে-মেয়ে। হেড স্যার হোঁচট খেতে খেতে সেখানে গিয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে নিতাই বাবু! আপনার ঘোল খেতে গিয়ে…’

‘চিন্তা করবেন না স্যার!…উউই দেখুন!’ বলেই নিতাই স্যার আঙুল দিয়ে দূরের রাস্তা দেখালেন।

কেরু আসছে। নদীর পার বরাবর রাস্তা ধরে বিজয়ীর ভঙ্গিতে কেরু আসছে। পেছন পেছন গোপাল ভাঁড় মার্কা সেই ঘোলওয়ালা, মাথায় চারটি খালি হাঁড়ি!

হেড স্যারের হাসি একান-ওকান হলো।

‘কী করে সম্ভব হলো নিতাই বাবু?’

‘অবস্থা জানতে পেরে ঘোলওয়ালার কাছে ছুটে গেলাম, বললাম, ‘কাকা, ঘোল তো খাওয়ালেন, এবার চারটা ভাত খাওয়ান! আমাদের হাঁড়ি খোয়া গেছে, আপনার ঘোলের হাঁড়িগুলো তো আমরা খালি করে ফেলেছি, চারটা হাঁড়ি কর্জ দিন!’…ব্যস, তাতেই কাজ হয়ে গেল!’

সবার মুখে হাসি। শুধু অঙ্ক স্যারের মুখ পুড়ে আছে।

চার ঘণ্টা ধরে চারদিকে গন্ধ ছুটিয়ে পেটে খিদে তুলে রান্না শেষ হলো। লাইন ধরে খেতে বসা হয়েছে। অঙ্ক স্যারের পরে হেড স্যার, তাঁর পরে নিতাই স্যার, তাঁর পরে কেরু।

খাসির রেজালা খেতে খেতে নিতাই স্যার কেরুকে বললেন, ‘কেরু ঘোলের হাঁড়িতে মাংস রান্না হয়েছে, ঘোল ঘোল গন্ধ পাচ্ছ?’

মাথা নেড়ে কেরু জানাল, ‘না।’

‘পাওয়া উচিত কি না?’

খাওয়া বন্ধ করে কেরু ভাবতে থাকল।

স্যার বললেন, ‘ঘোলের মধ্যে এক ধরনের অর্গানিক এসিড থাকে, যার গন্ধ তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা না।’

হেড স্যার এক মনে খেয়েই যাচ্ছেন। কেরু হাঁ করে নিতাই স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খাওয়া আপাতত বন্ধ।

নিতাই স্যার চাকুম-চুকুম করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, বুঝতে পারছ না?’

কেরু ভোমভোলার মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

নিতাই স্যার এবার সরে এসে কেরুর কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘোলের টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তাই বলে ৬৩৭ গ্লাসের টাকা তো আনিনি, তাই ঘোলওয়ালার কাছে চারটে হাঁড়ি বেচে… থুক্কু, বন্ধক দিয়েছি!’

কেরু যে অমন জোরে হেসে উঠবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। অঙ্ক স্যারের সন্দিগ্ধ চোখের পাশ দিয়ে সেই হাসির শব্দ নদীর ঢেউয়ের পিঠে চড়ে সুন্দরবনের গায়ে গিয়ে পড়ল। সুন্দরবনটাও হেসে উঠল অনেক দিন পর।