দেশের খবর: বহুল আলোচিত সদ্য বহিষ্কৃত নরসিংদী যুব মহিলালীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। রাজনীতির পাশাপাশি করতেন গাড়ি বিক্রি ও সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা। এর পাশাপাশি রাজনীতির আড়ালে মাদক ও নারী বাণিজ্য করেন তিনি। রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোতে আয়োজন করতেন পার্টির। সাপ্লাই দিতেন নারী। সুন্দরী তরুণীদের চাকরি দেয়ার নামে নরসিংদী থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। পার্টি গার্ল হিসেবে ব্যবহার করতেন তাদের। তারপর টাকার প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের শয্যা সঙ্গী করতে বাধ্য করতেন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন অপরাধ সাম্রাজ্যের রানি ‘পিউ’।
স্থানীয়রা জানায়, পাপিয়া একজন অটো গ্যারেজের মালিকের মেয়ে। এক সময় তাদের তেমন কিছুই ছিল না। গত পাঁচ বছরে বিপুল অর্থবিত্ত হাতিয়ে রাতারাতি বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট- কি নেই তার। দেশে গাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি বিদেশে দিয়েছেন বারও।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন, সাবিক্ষর খন্দকার (২৯), শেখ তায়্যিবাসহ (২২) আরও দুজন বিদেশে যাওয়ার প্রাক্কালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে আটক করেছে র্যাব। শুরুতে পাপিয়া প্রথমে নিজের দাপুটে অবস্থানের পরিচয় দেন। তবে কোনো কিছুতে গুরুত্ব না দিয়ে পাপিয়ার কাছ থেকে র্যাব কর্মকর্তারা উদ্ধার করতে থাকেন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
র্যাব জানায়, পাপিয়ার বার্ষিক আয় ১৯ লাখ টাকা হলেও পাপিয়া গত তিন মাসে শুধু একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন! এ ছাড়া তার নামে একটি হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট সব সময় বুকড থাকত। ওই হোটেলেই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল সাতটি মেয়ে। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, নগদ ২ লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল টাকা, ১১ হাজার ৯১ ইউএস ডলার, বিভিন্ন দেশের মুদ্রাসহ বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রা জব্দ করা হয়।
এর পরেই অসামাজিক কার্যকলাপ ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে পাপিয়াকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় যুব মহিলালীগ।
জানা যায়, নরসিংদীর বাগদী এলাকায় পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে পাপিয়া। বর্তমানে তার বাবার নিজ এলাকায় একটি অটো গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি অটো গাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে তাদের সংসার। সস্প্রতি পাপিয়া দোতলা আধুনিক একটি বাড়ি করেছেন। তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন গানের শিক্ষক মতিউর রহমান চৌধুরীর বড় ছেলে। মতিউর রহমান স্থানীয় নজরুল একাডেমির অধ্যক্ষ।
পাপিয়ার স্বামী সুমনের উত্থান: একসময় সুমনেরও তেমন কিছুই ছিল না। আধাপাকা টিনশেড ঘরেই কেটেছে তার শৈশব। এসএসসির গণ্ডি পার হওয়ার পর থেকেই জড়িয়ে পড়েন অপকর্মে। ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল সুমনের প্রধান পেশা। দূরদর্শী, চতুর ও মাস্টার মাইন্ড সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরে সুমন ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ে করেন পাপিয়া চৌধুরীকে। তাদের ঘরে মাদহাত চৌধুরী ইসাব নামে আট বছরের একটি ছেলে রয়েছে।
২০১২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় ভাড়া বাসার সামনে শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক থাকা অবস্থায় সুমনের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। তখন সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলি বিদ্ধ হয় তার স্ত্রী পাপিয়ার পেটে। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। এরপর থেকে পাপিয়া চৌধুরী ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন রাজধানীর সাবেক এক সংরক্ষিত এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা রয়েছে বলে জানা যায়।
স্বামী সুমনের সঙ্গে পাপিয়া ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও পাপিয়া চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সুমন শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ও তার স্ত্রী পাপিয়া যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এলাকায় তাদের বিশাল কর্মী বাহিনী রয়েছে। বিশাল শোডাউন আর শত শত লোকজন নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি মিছিল, সভায় তারা যোগ দেন। নরসিংদী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী যারা তার অনুসারী তারা ‘কিউ অ্যান্ড সি’ ট্যাটু ব্যবহার করেন। মাঝে মধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে।
স্বামী-স্ত্রীর যত সম্পদ: নরসিংদী জেলা শহরে বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় একটি পাকা ও আরেকটি সেমিপাকা টিনশেড বাড়ি রয়েছে পাপিয়ার। সেমিপাকা টিনশেড বাড়িটি তিনি এবং তার অনুসারীরা বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করেন। একই এলাকার বেলদী মোড়ে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ এবং আরেকটি ৬ শতাংশের মূল্যবান দুটি প্লট রয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে স্বামীর দোতলা একটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ বিলাসবহুল ভবনে পাপিয়া ও তার স্বামীর নামে রয়েছে দু’টি ফ্ল্যাট। এছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দু’টি মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোহা ও একটি ভিজেল কার রয়েছে। নরসিংদী শহরে পাঁচটি মোটরসাইকেল রয়েছে বলে জানা যায়। মোটরসাইকেলগুলো তার অনুসারীরা ব্যবহার করেন।
পাপিয়ার বাড়িনরসিংদী জেলা শহরে সুমন চৌধুরীর কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কার ওয়াশ ব্যবসার আড়ালে এখানে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে। তার স্বামীর মালিকানায় থাইল্যান্ডে একটি বারও রয়েছে। নরসিংদীর এসএমই শাখায় গত বছরের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ২৩ হাজার ৮২৯ টাকা জমা ছিল। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের নরসিংদী শাখায় পাপিয়ার হিসাবে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ টাকা ছিল। সিটি ব্যাংকে তার তিনটি হিসাব নম্বরের খোঁজ পাওয়া যায়। এর একটিতে ১ লাখ, অন্য দু’টিতে ৫০ হাজার ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ডিপোজিট পাওয়া যায়। তার সিটি ব্যাংকের একটি অ্যামেক্স গোল্ড ক্রেডিট কার্ড ও একটি এমেক্স গ্রিন ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। রাজধানীর এফডিসি গেটের সঙ্গে ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামে রয়েছে তার একটি গাড়ির শোরুম।