দেশের খবর: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম তিনজন রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। শুরুতে বিদেশফেরত ও তাদের স্বজনদের মধ্যে এই সংক্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত শনিবার রাজধানীর মিরপুরে একজনের মৃত্যুর পর সংশ্নিষ্টরা ধারণা করছেন, ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। কারণ মিরপুরে মৃত ব্যক্তি বিদেশফেরত ছিলেন না কিংবা তার কোনো স্বজনও বিদেশ থেকে ফেরেননি। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকায় হাসপাতালের এক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এ চিত্র থেকে বলা যায়, রোগটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ দেশের জন্য ‘পিকটাইম’ বলে মনে করছেন ভাইরোলজি (জীবাণু) বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ভাইরাসটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সরকারের সঙ্গে সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে কিনা তা বলার জন্য তারা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপসংহারে পৌঁছাতে চান। মিরপুরে মৃত ওই ব্যক্তির ছেলের গত রোববার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়েছে। তিনি লিখেছেন, তার বাবা বা তার পরিবারের কেউ সম্প্রতি বিদেশ থেকে আসেননি। তবে তিনি বাসার কাছে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। স্থানীয়রা বলেছেন, ওই ব্যক্তির শরীরে করোনা উপসর্গ ছিল। কিন্তু শুরুতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। পরে পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ এসেছে। রাজধানীর বাইরে কয়েকটি অঞ্চলে কয়েকজন ব্যক্তিকে করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ করছেন সংশ্নিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা। আইইডিসিআর থেকে ওইসব রোগীর নমুনা আনার জন্য কাউকে না পাঠানোয় তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এখনও সম্ভব হয়নি। এ কারণে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না তারা করোনা আক্রান্ত। তবে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণ শুরু কথাটি বলার জন্য তারা আরেকটু সময় নিতে চান। তিনি বলেন, মিরপুরে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, ওই এলাকায় দু’জন বিদেশফেরত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তাদের মধ্যে কোনো সংক্রমণ ছিল কিনা কিংবা তাদের কাছ থেকে এটির সংক্রমণ হয়েছে কিনা। পরিচালক আরও বলেন, সিলেটে সন্দেহভাজন আরও একজনের বিষয়ে আইইডিসিআর ব্যাপকভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। অন্যদের ক্ষেত্রে লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দেওয়ার চার দিন আগে থেকে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হলেও এসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে ১৪ দিনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগেভাগেই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস টানা ১০ দিন বন্ধ থাকছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আজ মঙ্গলবার থেকে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী। দেশের পাঁচজন ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাদের মাধ্যমে এটি ছড়ালে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই তা প্রকাশ পাবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা করছেন। তাদের অভিমত- আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা নাগরিকদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে অথবা হাসপাতালে ভর্তি করে আইসোলেশনে রাখা গেলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এখন কাজ হবে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের স্বজন ও আশপাশের ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনের আওতায় আনা। সেটি সম্ভব হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক সময় বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই সময়ে দেশে করোনাভাইরাসটির পিকটাইম হতে পারে। সংক্রমণ কোন পর্যায়ে ছড়াবে, তা এই সময়ের মধ্যেই প্রকাশ্যে আসবে। এখন যেসব সতর্কতার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো আরও আগে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। বিদেশ থেকে আসা বন্ধ করার বিষয়ে আরও আগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। আবার জনসমাবেশ, জমায়েতসহ যেসব বিষয়ে সরকার এখন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, সেটিও আরও আগে নিলে ভালো হতো। এখন সবচেয়ে বড় বিষয় চিকিৎসক, নার্সসহ সেবার সঙ্গে যুক্তদের কাছে জরুরিভিত্তিতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) পৌঁছে দেওয়া। অন্যথায় হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সেবা দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক সংক্রমণের শিকার দেশগুলোতেও প্রথমে দুই থেকে তিনজনের দেহে প্রথমে এটির সংক্রমণ দেখা দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রথমে দু-এক ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রতিবেশী, স্বজন থেকে শুরু করে সর্বত্র বিস্তার ঘটে। এই ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ পেতে ১৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। কারও কারও ক্ষেত্রে আরও আগেভাগে তা প্রকাশ পায়। সাধারণ সর্দি-কাশি ও ফ্লুর সঙ্গে এর মিল থাকার কারণে পরীক্ষা না করে কেবল লক্ষণ-উপসর্গ দেখে এই ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের একটি স্থানে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ আছে। এ কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানের রোগীদের পরীক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। আবার কাউকে আনা গেলেও তাতে অনেক বিলম্ব হচ্ছে। তবে সরকার আরও আটটি স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এর ব্যাপকতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করেছে। একজনের দেহেও শনাক্ত না হলে সেই দেশ স্তর-১-এ থাকবে। বিদেশফেরত ব্যক্তির শনাক্ত ও তাদের মাধ্যমে আরও দু-একজনের দেহে সংক্রমিত হওয়া দেশ স্তর-২-এ থাকবে। নির্দিষ্ট কিছু এলাকার বা নির্দিষ্ট কিছু মানুষ সংক্রমিত হলে তা স্তর-৩-এ থাকবে। আর সংক্রমণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে তা স্তর-৪-এর আওতায় পড়বে। গতকাল সোমবার সরকার দেশে নতুন করে ছয়জনসহ মোট ৩৩ জন আক্রান্ত এবং তিনজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে। আক্রান্ত ৩৩ জনের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বসবাস করতেন ১৫ জন। এরপর মাদারীপুরে ১০ জন, নারায়ণগঞ্জে তিনজন, গাইবান্ধায় দুইজন, কুমিল্লা, গাজীপুর ও চুয়াডাঙ্গায় একজন করে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশ থেকে এসেছেন। অন্যরা তাদের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে সংক্রমিত হয়েছেন। দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। ওই দিন থেকে বাংলাদেশ স্তর-২-এ পড়ে। এর আগ পর্যন্ত স্তর-১-এ ছিল। কিন্তু মিরপুরে আক্রান্ত ওই ব্যক্তির মৃত্যু এবং তার মাধ্যমে হাসপাতালের আরও একজন চিকিৎসক সংক্রমিত হয়েছেন। একই সঙ্গে ওই বক্তির প্রতিবেশী আরও একজনের একই উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি স্তর-৩-এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কমিউনিটি পর্যায়ে রোগটির সংক্রমণ ঘটেছে, সেটি এখনও বলা যাবে না। মিরপুরে মৃত ওই ব্যক্তির আশপাশে যারা ছিলেন, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ওই এলাকায় দু’জন বিদেশফেরত ব্যক্তি পাওয়া গেছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই নমুনা পরীক্ষার পর বলা যাবে, তারা পজিটিভি কিনা অথবা তারা কারও মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন কিনা। এরপর বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। সূত্র:সমকাল