জাতীয়

করোনায় ১০৭ জন ডাক্তার ও ৬২ জন নার্স আক্রান্ত

By Daily Satkhira

April 20, 2020

দেশের খবর: করোনা মোকাবেলায় কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের প্রাণঘাতি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে দাায়িত্বপালন করতে গিয়ে ১০৭ জন ডাক্তার, ৬২ জন নার্স ও ৫১ জন স্বাস্থ্যকর্মী প্রাণঘাতি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

রোগীর অনুপাতে ডাক্তারদের মধ্যে আক্রান্তের পরিমাণ বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় কম ওমানহীন পিপিই সরবারা করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মহামরিতে রোগীর সুস্থতা ও সেবার জন্য দরকার ডাক্তার ও নার্স। এখন তারাই যদি প্রাণঘাতি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা পাবেন কিভাবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ না করায় এবং মন্ত্রণালয়ের নানা গাফিলতির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তারা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেক বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। শুধু তাই না সুরক্ষা পোশাক না নিয়ে উল্টো হুমকি দেয়ার কারণে অনেকের মনোবল চাঙ্গা হচ্ছে না।

চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭৪ জন ডাক্তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তারা এখন চিকিৎসাধীন আছে। তাদের মধ্যে ১২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরমধ্যে ২ জনের অবস্থা খারাপ। তারা আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। আর নার্স ও কর্মচারী মিলে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৬ জন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে সিলেটের একজন সহকারী অধ্যাপক করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

আক্রান্তের কারণ সম্পর্কে বিএমএ এর শীর্ষ নেতা বলেন, ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষার পারসোনাল পোশাক (পিপিই) সবই সরবরাহ থাকলেও যারা করোনা আইসোলেশন ইউনিট, করোনা ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন এবং যারা নমুনা কালেকশন করেন তাদের আন্তর্জাতিক মানের পিপিই দেয়া হচ্ছে না। করোনা রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পোশাক দেয়ার কথা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানহীন পোশাক সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সরবরাহকৃত মাস্কের বিষয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। করোনা আক্রান্ত রোগীদের এবং ল্যাবে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে এগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে না। এতে করে সন্দেহ করা যাচ্ছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি মাত্রায় করোনা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

পিপিই সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু কিছু পিপিই ওয়াশ করে ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত বা গ্রহণযোগ্য? আর কিছু পোশাক ওয়ানটাইম ব্যবহার করা হয়। রোগীদের অসত্য তথ্য বা করোনায় আক্রান্তের তথ্য গোপন রাখার কারণেও চিকিৎসক ও নার্স আক্রান্ত হচ্ছেন। এ কারণে বিভিন্ন হাসপাতালের সার্জারি ও গাইনির কোন কোন ইউনিটের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মিটফোর্ড হাসপাতালের সার্জারি, গাইনি বিভাগে ও সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। মিটফোর্ডের ঘটনায় ১৩ জন ডাক্তার ও নার্স আক্রান্ত। গাইনিতে ও কয়েকজন ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছে। যেসব ইউনিটের ডাক্তার ও নার্স আক্রান্ত হয়েছে সেসব ইউনিটের কাজ বন্ধ রয়েছে। পুরো বিভাগের কাজ বন্ধ হয়নি। মুন্সিগঞ্জের একজন মাওলানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভর্তি হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এতে এক ডাক্তার ও নার্সসহ পুরো ইউনিটের সবাইকে কোরেন্টিনে রাখা হয়েছে। এ ভাবে সিলেট ও গাজীপুরের কালিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর বিএমএ এর পক্ষ থেকে দেশের সব বিভাগ ও জেলার ডাক্তার ও সিভিল সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ ভাবে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামীতে চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব প্রফেসর ডা. এমএ আজিজ বলেন, সারাদেশে প্রায় ২০০ ডাক্তার ও নার্স আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ডাক্তারের সংখ্যা ৯০ জন। নার্স ও কর্মচারী মিলে সংখ্যা ২শ’ হবে। আক্রান্তের কারণ সম্পর্কে এ নেতা বলেন, ডাক্তারদের মানসম্মত সুরক্ষা পোশাক না দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর অনেক রোগী মিথ্যাচার করেছে। আর যেসব পোশাক ও মাস্ক দেয়া হচ্ছে তার মান নিয়ে এখন দেশব্যাপী বিতর্ক চলছে। নিম্নমানের পিপিই ব্যবহারের কারণে ডাক্তার, নাস ও কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছে। তবে উন্নতমানের সুরক্ষা পোশাক দেয়া হলে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদী। মিটফোর্ড, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎমক নার্স আক্রান্ত হওয়ায় ওইসব বিভাগের ইউনিটগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ডক্টর ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশে এ পর্যন্ত ১শ’র বেশি ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছে।

সিনিয়র আইসিইউ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডাক্তার দেবব্রত বনিক বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের বুঝাতে হবে যে আক্রান্ত হলেও আপনার চিকিৎসা হবে। রোগ লুকালে সমস্যা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কারণ অন্য রোগের কথা বলে ভর্তির পর অপারেশন করার আগে তাকে অ্যানেসথেশিয়া দিতে হবে। ফলে রোগী মারা যেতে পারে। আর সত্য কথা বললে অ্যানেসথেশিয়ার মাত্রা ওইভাবে দেয়া হবে। যেন রোগীর সমস্যা না হয়। রোগের তথ্য গোপন রাখায় গতকাল পর্যন্ত শুধু আইসিইউ ও অ্যানেসথেশিয়ায় ২৪ জন ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছে। এ হারে ডাক্তার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিবে বলে তিনি মনে করেন।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের এবং কেন্দ্রীয় ওষুধালয়ের ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র পরস্পর যোগসাজশে লাভবান হওয়ার জন্য পিপিই ও মাস্ক নিয়ে বাণিজ্য করছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞসহ সর্বস্তরের ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, তারা করোনাভাইরাসের প্রস্তুতি নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরও বিশেষজ্ঞদের কথার গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বরং বলছে বাঙালির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। কিছু হবে না। তারা কাগজে কলমে প্রস্তুতির কথা জানালে ও বাস্তবে ছিল তার উল্টো।

এদিকে নার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতা গতকাল রাতে সংবাদকে ফোনে বলেন, ঢাকা মেডিকেলে গত ২ দিনে ১০ জনসহ সরকারি হাসপাতালে ৩৮ জন এবং প্রাইভেটসহ সব মিলিয়ে তার মতে, আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ৬৪ জন।

বিএমএ নেতা বলেন, এভাবে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হতে থাকলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য হয়তো আর চিকিৎসকই থাকবে না দেশে।

চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের ধারণা হচ্ছে যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বহীনতা এবং ব্যর্থতার কারণেই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।