দেশের খবর: করোনাভাইরাসে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারাদেশে ২১৭ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ১১৭ জন। এ ছাড়া পুলিশের আরও সাত শতাধিক সদস্যকে প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা যে হারে করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে তা উদ্বেগজনক। সামনে মাঠ পর্যায়ে পুলিশকে করোনার আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে। পেশাজীবীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত একক হিসাবে পুলিশেই আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর পরই রয়েছেন চিকিৎসকরা। নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী যুক্ত করলে অবশ্য সে সংখ্যা সবার ওপরে। পুলিশে আক্রান্তদের অনেকেই তরুণ ও অবিবাহিত।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে গিয়ে সার্বিক দিকনির্দেশনা ও করোনা মোকাবিলায় নিজেদের করণীয় সম্পর্কে ব্রিফ করেন নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। এ সময় ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানায়।
পুলিশের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত ডিএমপির ১১৭ জন সদস্য করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে চারজন সিভিল স্টাফ। গত ২৪ ঘণ্টায় ডিএমপির ১৬ জন পুলিশ সদস্য সংক্রমিত হয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের টিঅ্যান্ডআইএমের একজন, এসবির ৫ জন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) ৩ জন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) ২৬ জন, ময়মনসিংহ-২ এপিবিএনের একজন, নৌ পুলিশের একজন, এন্টি টেররিজম ইউনিটের একজন, নারায়ণগঞ্জে ১৬ পুলিশ সদস্য, নরসিংদীতে ৬ জন, গাজীপুর জেলায় ৭ জন, কিশোরগঞ্জে ৯ জন, গোপালগঞ্জে ১৮ জন, শেরপুরে ৬ জন, ঢাকা জেলায় ৪ জন ও মুন্সীগঞ্জে ২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালকে ‘করোনা হাসপাতাল’ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। পুলিশের আক্রান্ত সদস্যরা সেখানে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই মাঠ পর্যায়ে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউন এলাকায় লোকজনের অহেতুক ঘরের বাইরে আসা নিয়ন্ত্রণ, করোনা আক্রান্ত অলিগলিতে টহল ডিউটি, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, ত্রাণ বিতরণ, ত্রাণ বিতরণে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা, রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছানোসহ করোনা আক্রান্ত রোগীর দাফনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন পুলিশ সদস্যরা। তাই পুলিশের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকছে। এমনকি শুরুতে অনেক পুলিশ সদস্যকে মাস্ক ও পিপিইসহ অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। এখনও অনেক পুলিশ সদস্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী পাননি।
পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশের মাঠ পর্যায়ের অনেক সদস্যের মধ্যে করোনা নিয়ে যথেষ্ট ও কার্যকর সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা নিজেদের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় না নিয়ে এখনও ঝুঁকি নিয়ে অনেকের সঙ্গে মিশছেন। এই অসতর্কতার কারণেও অনেক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হচ্ছেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানায় সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর দুই থানার সব পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা আক্রান্ত হওয়ার পর ২২ কর্মকর্তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। শেরপুরে এক ওসি ও দুই এসআই আক্রান্ত হওয়ার পর বিকল্প কর্মকর্তার মাধ্যমে থানার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সাড়ে ছয়শ’ বেডের হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে। পুলিশের নিজস্ব হাসপাতালে শয্যা আছে আড়াইশ’। আর সাড়ে চারশ’ বেডের দুটি হাসপাতাল ভাড়া নেওয়া হয়েছে। পুলিশ নিজেরাই পিসিআর ল্যাব বসাচ্ছে। তখন পরীক্ষার জন্য অন্য সংস্থার কাছে যাওয়া লাগবে না। পুলিশের জন্য ৫০টি আইসিইউ শয্যাও প্রস্তুত। যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশ পিছপা হবে না। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের নিজেদের সুরক্ষিত রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য দেখানো যাবে না। ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিএমপিতে প্রায় ১২০ জনের মতো সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি সব ধরনের খেয়াল রাখা হচ্ছে। আক্রান্ত ফোর্সরা যাতে মনে না করে, অসুস্থ হওয়ায় আমরা তাদের পাশে নেই- এ ধারণা ভেঙে দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শক ও আমি নিজে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাতে তাদের পরিবার কোনো দুশ্চিন্তায় না থাকে, সে লক্ষ্যে তাদের ইউনিট অফিসারকে সার্বক্ষণিক আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের খোঁজ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, পুলিশে যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বেশিরভাগ বাইরের ডিউটি করতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছে। তারা ত্রাণ কাজে অংশ নিয়েছে, লকডাউন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছে ও কাঁচাবাজার এলাকায় ডিউটিতে ছিল। তারা মানুষের সঙ্গে ক্লোজ কন্টাক্টে গিয়েছে। এটা ঠিক, আমাদের অনেক ফোর্স নিজেরা সচেতন নয়। এটা এমন রোগ, যেখানে নিজের নিরাপত্তার কথা আগে নিজেকে ভাবতে হবে।
পুলিশের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জানান- এ ধরনের পরিস্থিতিতে কীভাবে উন্নত বিশ্বের পুলিশ ফোর্স দায়িত্ব পালন করছে সেই গাইডলাইন আনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। যুক্তরাজ্যের দূতাবাস থেকে একটি গাইডলাইন আমরা নিয়েছি। সে আলোকে আমাদের পুলিশ বাহিনীর জন্য একটা ওয়ার্কিং গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। কেউ আক্রান্ত হলে প্রথমে কোথায় রিপোর্ট করবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যাবে, ছোট ছোট ক্লাস্টারে ভাগ করে দায়িত্ব পালন, ফোর্স বাইরে থেকে আসার পর কী কী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ব্যারাকে বা নিজ থাকার জায়গায় ফিরবে- এসব সবিস্তারে সেখানে বলে দেওয়া হয়েছে। ফোর্সদের খাবারের জায়গা, টয়লেট, ব্যারাক ও গোসলখানা কিছু সময় পরপরই জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। ফোর্স যেখানে থাকে, সেখানে জীবাণুমুক্তকরণ মেশিন বসানো হচ্ছে। যেসব সদস্যের সর্দি, কাশি ও জ্বর রয়েছে তাদের আলাদা রেখে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
শেরপুরের পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ফেব্রুয়ারির পর থেকে নিরলসভাবে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। বলতে গেলে এ সময় তারা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ ও পণ্যের সরবরাহের চেইন ঠিক রাখতেও কাজ করা হচ্ছে। কৃষকদের মধ্যে সার-কীটনাশকও বিতরণ করছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, নারায়ণগঞ্জে যেসব পুলিশ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সংক্রমিত হওয়ার নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা চেকপোস্টে, বাইরে ডিউটি করেছে, আবার আসামি ধরেছে। নারায়ণগঞ্জের চিত্র উদ্বেগজনক। এখানে যারা ভাসমানভাবে বসবাস করেন তাদের ঘরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এটি এমন একটি জেলা যেখানে অন্য ৬৩ জেলার লোক বসবাস করে।সূত্র: সমকাল