অর্থনীতি

লকডাউন কার্যকরে সমন্বয়ের অভাব, আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়

By Daily Satkhira

May 01, 2020

দেশের খবর: লকডাউন কার্যকরে সমন্বয়ের অভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এক দিকে সংক্রমণ বাড়ছে অন্য দিকে পাড়া মহল্লায় দোকান খোলা রাখার সময় বাড়ানো হচ্ছে। ইফতারের দোকান খোলা হচ্ছে, দূরপাল্লার ট্রেন চালুর কথা ভাবা হচ্ছে।

গার্মেন্ট খোলা এবং বন্ধ নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটছে। খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই লকডাউন শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ এ বিষয়ে করোনা সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে কেউ কোনো আলোচনাও করছে না।

এসব কিছুর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সমন্বিতভাবে না হওয়ায় লকডাউন সেভাবে কার্যকর হয়নি। ফলে সংক্রমণ বাড়ছে।

তারা বলেন, আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়। সবাই মিলে পরিকল্পিতভাবে সময়টা পার করতে হবে। এ সময় পর্যন্ত লকডাউন কঠোর করা বা শিথিল করার বিষয়ে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানুষ কঠোরভাবে লকডাউন মেনে চলেননি। নানা অজুহাতে ঘরে বাইরে এসেছেন। অথচ সরকার চেষ্টা করেছে জনগণকে ঘরে রাখতে। এজন্য পুলিশ র‌্যাবের পাশাপাশি মাঠে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে।

সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গণপরিবহন। এত কিছুর পরও তেমন কাজ হয়নি। মানুষ নানা অজুহাতে বাইরে এসেছে। এতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে। এখন পর্যন্ত সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বিতভাবে আরও কঠোর লকডাউন করা সম্ভব না হলে অবস্থা খারাপ হতে পারে। তারা বলেন, রাস্তায় জনসমাগম থাকলে করোনার সংক্রমণ রোধ কষ্টকর।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-আইইডিসিআরের তথ্য মতে, দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এরপর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ২১৮ জন। এরপর ৯ এপ্রিল আক্রান্ত হয় ১১২ জন। ১৪ এপ্রিল এই সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ২০৯ জনে।

পরে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মাত্র ৪ দিনের মাথায় ১৮ এপ্রিল শনাক্ত হন ৩০৬ জন, ২০ এপ্রিল ৪৯২ জন, ২৪ এপ্রিল ৫০৩ জন, ২৮ এপ্রিল ৫৪৯ জন এবং ২৯ এপ্রিল ৬৪১ জন। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর বলেছেন, করোনাভাইরাসের যে ধারায় রয়েছে তাতে মে মাসের মাঝামাঝিতে এটা পিকে উঠতে পারে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবে ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় লকডাউন ঘোষিত হলেও সেটি প্রতিপালিত হচ্ছে না। এরই মধ্যে দোকান ও ইফতার বিক্রিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিফল আমরা আগামী ১০ থেকে ১৪ দিনের মধেই দেখতে পাব।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ঘোষণা করব কিন্তু মানব না তাহলে হবে না। শুরু থেকেই কঠোরভাবে লাকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রিত রাখা সম্ভব হতো। যদি শুরুতেই ট্রায়াজ প্রটোকল মানা হতো, ভুয়া পিপিই দিয়ে, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা রেখে শত শত হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট, ইত্যাদি) কোভিড-১৯ পজিটিভ বানিয়ে জনস্বাস্থ্য বাহিনীকে সঙ্কুচিত করা না হতো।

অথচ তাদের অনলাইনে নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ঘায়েল করা হল। ওই সময়ে অনেক হাসপাতালে তখন ইন্টারনেটের সংযোগই ছিল না। ১২ বছর ধরে সরকারিভাবে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ। অন্য দিকে কনট্যাক্ট ট্রেসিং এবং নমুনা সংগ্রহের মতো বিশেষায়িত কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের। অথচ অন্যান্য দেশে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে নিয়োগ করা হয়েছে শত শত এপিডেমিওলজিস্ট।

তারা বলেন, পুরো পৃথিবীর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে কোনো ভাইরাল এপিডেমিক কন্ট্রোল সিস্টেমের ব্যাকবোন বা মেইন পিলার। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে, তার পেছনে প্রধান কারণ ছিল এগ্রেসিভ টেস্টিং অ্যান্ড কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং।

আমেরিকা, ব্রিটেন, স্পেন, ইতালির মতো দেশগুলো প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কয়েক দিন আগে থেকে তারা আবার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য কয়েকশ’ এপিডেমিওলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। এটি সফল করতে কয়েকটি দেশে সেনাবাহিনীর সাহায্য পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ।

গুগল এবং অ্যাপলের মতো কোম্পানি এক হয়ে চেষ্টা করছে আরো কার্যকর ক্রস প্ল্যাটফর্ম এ কাজ করতে পারবে এমন এপ্লিকেশন ডেভেলপ করার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়েছে এর পরীক্ষা করা নিয়ে। প্রথম থেকেই একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গণমাধ্যমে বলে আসছিলেন, একমাত্র তাদেরই এই পরীক্ষা করার উপযুক্ত ল্যাব, কিট এবং ম্যান পাওয়ার আছে।

বাস্তবতা হল বিভিন্ন সরকারি, প্রাইভেট এবং স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় মিলে কমপক্ষে অর্ধশত পিসিআর মেশিন এই মুহূর্তে চলমান আছে। সেগুলো চালানোর জন্য লোকবলও আছে, ট্রেনিং দেয়ার লোকও আছে।

শেষে প্রধানমন্ত্রী জেলা পর্যায়ে পিসিআর ল্যাব চালুর নির্দেশ দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়। তার পরও আমরা যে পরিমাণ টেস্ট করা প্রয়োজন তার দশ ভাগের এক ভাগও করতে পারছি না।

আরেকটি বড় সমস্যা হল হাসপাতাল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা এখানে। করোনা রোগীদের জন্য কী ধরনের হাসপাতাল প্রয়োজন, আমাদের নীতিনির্ধারকরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। একটা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল আর একটা করোনা আইসোলেশন সেন্টার ভিন্ন বিষয়।

নামমাত্র কয়েকটি হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে একটি, হাসপাতালকেও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে তৈরি করতে পারিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেদিন ইতালি ফেরত ১৪২ জন প্রবাসীকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন করতে সরকার ব্যর্থ হয়, সেদিনই দেশের কফিনে প্রথম পেরেক মারা হয়ে গিয়েছিল। আর শেষ পেরেক মারা হয়েছিল গণপরিবহন, আন্তঃজেলা চলাচল বন্ধ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা।

কোয়ারেন্টিন সেন্টার হিসেবে কখন লঞ্চ, কখন শপিংমলের ছাদ, কখনো স্টেডিয়াম কত কী ভাবা হচ্ছে। অথচ সারা দেশে আবাসিক সুবিধা সম্পন্ন যে হাজার হাজার প্রাইভেট হোটেল পড়ে আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা করা হয়নি।

সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয় হোটেল ব্যবহার করা হবে। অন্য দিকে হোটেল মালিকরা বলেন তারা কিছুই জানেন না। কোনো বিষয়ে জোরালে সমন্বয় নেই বলে তারা মনে করেন।

করোনায় দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে সঠিক নিয়মে ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক রেখে সীমিত আকারে দেশের কিছু শিল্প কলকারখানা খুলে দেয়ার পক্ষে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশের কিছু মানুষ কর্মহীন হয়ে অনাহারে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক রেখে সীমিত পরিসরে কিছু শিল্প কলকারখানা খুলে দেয়া হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আমরাও সামনেই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাব।

বুধবার দুপুরে রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে নতুন করোনা আইসোলেশন সেন্টার পরিদর্শনকালে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এসব তথ্য জানান।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে টেকনিক্যাল কমিটির সদস্যবিশিষ্ট প্রাণ রসায়নবিদ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ সাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ব্যবসায়ীদের মতো হয়েছে মন্ত্রীর মতো নয়।

তিনি বলেন, যে হারে পজেটিভ কেস পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাজধানীতে জনসমাগম ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই সবকিছু চিন্তভাবনা করে করতে হবে। সূত্র: যুগান্তর