দেশের খবর: করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এবার মে দিবস ছিল ভিন্নরকম। এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে রাজপথে লাল পতাকার মিছিল বা জমায়েত ছিল না।
লকডাউনের এবং পরিস্থিতির কারণে শ্রমজীবী মানুষের জীবন থেমে গেছে। কাজ হারানো, চাকরিচ্যুতি এবং শ্রমিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে এবার ইস্যু হিসাবে তুলে ধরেছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিক নেতারা বলেছেন, এখন বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির বদলে শ্রমিকের টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার প্রশ্নই তাদের ভাবাচ্ছে। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় একটি গার্মেন্টস কারখানা দু’দিন আগে লে-অফ করে দেয়ায় চাকরি হারিয়েছেন প্রায় দুইশো শ্রমিক। তাদের একজন সালমা আকতার দুই সন্তান এবং স্বামী নিয়ে কারখানার কাছাকাছি এলাকাতেই ভাড়া করা ঘরে থাকেন। তিনি বলেছেন, লকডাউনের শুরুতে কারখানা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কারখানা আবার খোলা হচ্ছে, এই খবর পেয়ে দু’দিন আগে সেখানে গিয়ে কারখানা লে-অফ করার নোটিশ দেখতে পান। সালমা আকতারের স্বামী একজন পরিবহন শ্রমিক এবং তারও কাজ নেই। সালমা আকতারের প্রশ্ন এই অনিশ্চয়তা থেকে কীভাবে তিনি ঘুরে দাঁড়াবেন। “এই যে করোনা পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতির মধ্যেই তারা নোটিশ ঝুলায় দিছে যে কারখানা চলবে না। মানে গার্মেন্টসটা বন্ধ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তেতো আমরা চাকরি পাব না। আমরা কি করবো, কোথায় যাব? সামনে ঈদ। এখন আমরা কীভাবে বাঁচবো?” গাজীপুরে কালিয়াকৈর এলাকার একজন গার্মেন্টস শ্রমিক আব্দুল হাকিম লকডাউনের মধ্যে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তাকে কারখানা খোলার খবর দেয়া হলে তিনি অনেক কষ্ট করে কর্মস্থলে আসেন। কিন্তু তিনি কারখানায় গিয়ে দেখেন আরও অনেকে সাথে তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। “আমাদের ছাঁটাই করেছে জোরপূর্বক। এখন আমরা চাকরি পাব কোথায়? আমরা মালিকের কাছে গেলাম এবং বললাম, স্যার আমরা এখন কী করবো? ঈদ সামনে। আমাদের তো পরিবার আছে। আমরা কি করবো? সে বললো, তোরা যা পারিস কর।” যদিও সরকার বলছে, এখন কোন শিল্প কারখানায় কোন শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। কিন্তু শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ বাড়ছেই। শ্রমিক সংগঠনগুলো বলেছে, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক শিল্পে এরই মধ্যে ৭০ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। আর অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা লকডাউন পরিস্থিতিতে একেবারে কর্মহীন হয়ে রয়েছেন। সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষ যে অনিশ্চয়তায় পড়েছে, তাতে তাদের টিকে থাকার বিষয়টিই এখন একমাত্র ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। “বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষ যারা শ্রমবাজারে আছেন, তার মধ্যে পাঁচ কোটিরও বেশি রয়েছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। এই খাতে শ্রমিকের আয় পুরোটাই নির্ভর করে আসলে দিন এনে দিন খাওয়া-এরকম একটা অবস্থার ওপর। তাদের সঞ্চয় থাকে না। আর আনুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক, সেখানেও যে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের আয়ও এমন নয় যে সঞ্চয় থাকে।” তিনি আরও বলেছেন, “অনেকে শ্রমিক ছাঁটাইয়েও চলে গেছেন। এই যদি হয় আনুষ্ঠানিক খাতের অবস্থা তাহলে অনানুষ্ঠানিক খাতে তো যারা কাজ দেন, তাদের কোন দায়ই থাকে না। সেখানে শ্রমিকের সাথে কোন চুক্তিই থাকে না। এমন প্রেক্ষাপটে এবার মে দিবসের প্রতিপাদ্য একটাই যে তারা বেঁচে থাকতে চায়।” শ্রমিক নেতারাও বলছেন, শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না এবং কারখানা লে-অফ করা যাবে না-এই দু’টি দাবিকেই তারা এখন সামনে আনছেন। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বিলস এর কর্মকর্তা কোহিনূর মাহমুদ বলেছেন, পরিস্থিতি আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা এখনও ধারণা করা যাচ্ছে না। “যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অনিশ্চয়তা সব সময় ছিল। কিন্তু এখন তাদের জীবন জীবিকা একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের আনুষ্ঠানিক খাতেও একটা বড় ঝুঁকি। যেমন বেশিরভাগ হোটেল রেস্টুরেন্ট এখন বন্ধ এবং এর শ্রমিকদের কোন কাজ নেই। আরএমজি সেক্টরটা খুব আলোচিত এখন। এই গার্মেন্টস খাত নিয়ে আমরা একটা কেমন যেন ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছি।”
কোহিনূর মাহমুদ উল্লেখ করেছেন, “পরিবহন শ্রমিকের কাজ পুরোই বন্ধ। নির্মাণ শ্রমিকেরও কোন কাজ নেই। এই পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে- আসলে ভেবে পাই না, বিশ্বাস করুন। শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যটা কী হবে?”
ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নামের একটি শ্রমিক সংগঠনের নেতা ডা: ওয়াজেদুল ইসলাম বলেছেন, কারাখানা লে-অফ এবং শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে না পারলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের বক্তব্য হচ্ছে, কারখানা লে-অফ করা বা শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ তারা পাচ্ছেন না। তিনি উল্লেখ করেছেন, সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেলে সরকার তাতে ব্যবস্থা নেবে।
প্রতিমন্ত্রী তাদের পুরোনো বক্তব্যই তুলে ধরেন, তিনি বলেন, “এই মহামারির মধ্যে কোন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে না এবং কোন কারখানা লে-অফ করা হবে না-শ্রমিকের বেতন-মজুরি বা খাবার, মালিকরা তাদের সাধ্যমতো দেবেন। আর সরকারি শিল্প কারখানায় কোন ছাঁটাই হবে না। এটাই সরকারের সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেছেন,সারাদেশে অসহায় এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে, তাতে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাও সাহায্য পাচ্ছেন।
তবে শ্রমিক নেতারা বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে থমকে গেছে, তার চাপে গার্মন্টস সহ বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্পের শ্রমিকদের সংকট বাড়লে, সেটা সামাল দেয়ার জন্য কার্যকর কোন পরিকল্পনা তারা দেখছেন না। *বিবিসিবাংলা অবলম্বনে