সাতক্ষীরা

চলে গেলেন সাংবাদিক ফখরে আলম —সুভাষ চৌধুরী

By daily satkhira

May 16, 2020

‘পুরষ্কারের জন্য নয়, খবরের পেছনে ছুটেছি নিজের নামযশ বাড়বে, জনগনের কল্যান হবে, জনসচেতনতা বাড়বে এ কারনেই’। যশোরের চাঁচড়া মোড়ের ‘হুদা কটেজ’ থেকে অনুজ কবি সাংবাদিক ফখরে আলম তার একটি প্রতিবেদন সংকলনে একথা উল্লেখ করেছেন। আর এই একই লক্ষ্য নিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন গ্রামবাংলার চিত্র, মানুষের জীব জীবিকা। ১৯৯৭ সালে এক প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন ঝিনাইদহ জেলার সুরাট ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের কোনো মহিলা কোনোদিন ভোট দেননি। কেউ তাদেরকে ভোট দিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেনি। এক্ষেত্রে পুরুষরা মহিলাদের পর্দার কথা বলে। চেয়ারম্যান, মেম্বর, মোড়ল, মাতব্বর এমনকি প্রভাবশালীরাও তাদের ভোটের মাঠে যেতে দেয়নি ৫০ বছর ধরে। অথচ পাশের গ্রামের মেয়ে পুরুষরা কেয়ারের রাস্তা মেরামতের কাজ করে। এমনকি ক্ষেত খামারেও কাজ করে। যত অসুবিধা ভোটকেন্দ্রে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা এই গ্রামেরই এক শিক্ষিত নারী বলেন মেয়েদের ভোট দিতে দেওয়া হয় না এটা অন্যায়। ভোট দিয়েই বা কি, কারন গ্রামের চারপাশ সারাবছর থাকে কাদায় ভর্তি। কোনো উন্নয়নই তো হয় না। ফখরে আলম একই সালের আরেকটি প্রতিবেদনে লিখেছেন বাংলাদেশের অনেক গ্রামের মহিলারা কম পানি খায়। রাত জেগে থাকে। এসব কারনে নানা অপুষ্টিতে ভোগে তারা। ঝিনাইদহ ও যশোরের কয়েকটি গ্রামের এমন চিত্র তুলে ধরে এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, গ্রামের এসব দরিদ্র পরিবারের নিজস্ব কোন শৌচাগার (পায়খানা) নেই। তাছাড়া গাছপালা কেটে বিভিন্নরকম চাষাবাদ করায় কোন জঙ্গলা জায়গাও নেই। পুুরুষ ছেলেরা উন্মুক্ত জায়গায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারলেও মেয়েদের জন্য সেটা লজ্জাকর। একারনে তাদের অপেক্ষা করতে হয় রাতের জন্য। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তাদের সময় হয় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার। তারা দিনে খায়ও কম।

এ ধরনের প্রতিবেদন লিখে ফখরে আলম সরকারকে সচেতন করেছেন। সমাজকে সচেতন করেছেন এবং জনগনের জন্য কল্যান বয়ে এসেছেন। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এই অনুজ সাংবাদিক অন্তিম যাত্রা করেছেন। তার আগে তিনি পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ কোনটিই উপভোগ করতে পারেননি। কারন মরনব্যাধি ব্লাড ক্যান্সার তার দুই চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল বেশ আগেই। তার অকাল মৃত্যুর খবরে আমিও বিস্মিত হয়ে পড়ি। আমার সাংবাদিকতা জীবনের একজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এই ফখরে আলম। তার বাবা মোঃ শামসুল হুদা ১৯৮৮ সালে সাতক্ষীরা জেলায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক ছিলেন। তার মাধ্যমেই ফখরে আলমের সাথে আমার পরিচয় । এরপর ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা ট্রাস্টের পত্রিকাগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর ১৯৯৮ সালে আমি স্থান পাই ভোরের কাগজে। ফখরে আলমও দক্ষিনাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দেন ভোরের কাগজে। সেই সাথে একসঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের এক যৌথ রিপোর্টের কারনে ভোমরার ফজর আলী (ঘেগো) প্রতারনামূলক ভাবে নিরীহ মানুষের মাঝে সব অসুখ সারার নামে এক ধরনের শিকড় বিতরন করে প্রচুর টাকা লুটে নিচ্ছিল। আমাদের যৌথ প্রতিবেদনের ফলে তার এ প্রতারনা থমকে যায় এবং শেষ পর্যন্ত তা বন্ধও হয়ে যায়। ফখরে আলম ৯৫ সালের শেষ দিকে সাতক্ষীরায় এসেছিলেন এ এলাকার চিংড়ি চাষ নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। তখন তিনি বাংলাবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন। সে সময় তার রিপোর্টে উঠে আসে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, দেবহাটা এবং সাতক্ষীরা সদর ও তালার বেশীরভাগ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বর ও প্রভাবশালী অর্থশালী ব্যক্তি চিংড়ি ঘেরের মালিক। তারা চিংড়ি চাষ করে সমাজের দরিদ্র মানুষকে পথে বসিয়েছেন। জেলেদের জাল ও জলা এবং দরিদ্র মানুষের ধানের জমি কেড়ে নিয়ে ধনিক বনিক ও পুজিপতিরা শত শত একরে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি ঘেরের মালিক হয়েছেন। অপরদিকে জেলেরা তাদের মাছ ধরা পেশা হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। জমি হারিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন অনেকে। এই চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি চাষ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সম আলাউদ্দিনের (দৈনিক পত্রদূতের প্রয়াত সম্পাদক)। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিপর্যয় যা হবার তা হয়েই গেছে। জোয়ারের নোনা পানি ঢুকে কৃষি জমি সয়লাব। এখন আর ধান ফসলের আশা করছেন না কৃষক। চিংড়ি চাষ প্রতিরোধে নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে সম আলাউদ্দিন বলেন, সরকার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যে চিংড়ি চাষে উৎসাহ দিয়েছে। তবে অপরিকল্পিত এই চাষের ফলে আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ফখরে আলম বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ সহ দেশের দক্ষিন পশ্চিম এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে পাওয়া মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের সন্ধানের ওপর সরেজমিন কয়েকটি রিপোর্ট করেন। এসব রিপোর্টে তিনি আর্সেনিকের বিষ কিভাবে মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে তার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। আর্সেনিক আক্রমনের প্রথম পর্যায়ে ফখরে আলম সহ কয়েকজন সাংবাদিকের এসব রিপোর্ট সরকারকে নাড়া দেয় এবং সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করায় বাংলাদেশে এই নিয়মিত বিষপান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। একই সাথে বেসরকারি সংস্থাগুলিও আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। সুন্দরবনের সম্পদ লুটপাটের কাহিনী নতুন কিছু নয়। তবু বনের প্রাণিজ ও বনজ সম্পদ লুটপাটের সচিত্র বহু প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন তিনি। চোখে আঙ্গুল দিয়ে সরকারকে দেখিয়েছেন কিভাবে এই সম্পদ লুটে খাচ্ছে চোর বাটপাররা। তারা হরিণ শিকার করছে। বাঘ কুমির মেরে ফেলছে। চামড়া পাচার করছে । সরকারের দরজায় এসব রিাের্ট নতুনকরে কড়া নাড়ে। বন্জ সম্পদ লুটপাট বন্ধ না হলেও সরকার ও সমাজকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে করে তোলা হয় এসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে। কৃষি জমিতে ফসল কম হয় কেনো। অনুসন্ধানে ঘাটতে গিয়ে সাংবাদিক ফখরে আলম দেখতে পান বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার মাটিতে কিছু কিছু প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে দস্তা ও বোরন অন্যতম। তাছাড়া পৃথিবীর বহু দেশে বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও মাটি পরিক্ষা করে কৃষককে উপকরণ ঘাটতি পূরন এবং সে জমিতে কোন ফসল ভালো হবে তা জানিয়ে দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়ন কাগজ কলম আর ফাইলের মধ্যে। কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে দেখা মেলাই ভার। ফখরে আলম এতোটুকু ভয় পাননি গ্রামীন সন্ত্রাসের চিত্র তুলে ধরতে। যশোর , সাতক্ষীরা, নড়াইিল ,ঝিনাইদহের গ্রামে গ্রামে আঁখি বাহিনী, আসাদ বাহিনী, রশীদ বাহিনী, নড়াইলের জোহা গ্রুপ, সাতক্ষীরার বরুণ গ্রুপ, মৃণাল বাহিনী, চুয়াডাঙ্গার সিরাজ বাহিনী, মেহেরপুরের রুহুল বাহিনী, ঝিনাইদহের টিপু বাহিনীর হত্যা ও সন্ত্রাসের সরেজমিন চিত্র তুলে ধরেন। তাদের হাতে কতো নারী বিধবা হয়েছেন, কতো বাবা পুত্রহারা হয়েছেন, কতো সন্তান পিতৃহারা হয়েছেন তার হিসাব মেলানো ভার। তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এসব সন্ত্রাসের বপক্ষে লেখেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের করুন জীবন কাহিনী তুলে ধরে সরকারে ঝাঁকুনি দেন। ১৯৯৬ সালে সরকার এসব সন্ত্রাসীকে আত্মসমর্পনের সুযোগ দিয়ে তাদের পুনর্বাসিত করেন। সাংবাদিকতার অন্যতম মূল নীতি ‘সহজ কথা সহজভাবে বলা’ র মধ্য দিয়ে ফখরে আলম তার প্রতিবেদনে সত্যিই আমাদের গ্রামীন চিত্রকে চিত্রায়িত করেছেন। এতে সমাজ ও সরকার উপকৃত হয়েছে। অসময়ে আমরা এমন একজন কিিব ও সাংবাদিককে হারালাম যার হাত দিয়ে আর কখনও উঠে আসবে না এসব চিত্র। ———- সুভাষ চৌধুরী, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি,দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি