রাজনীতি

জাতীয় নির্বাচন: দল গোছাতে আগাম মাঠে নেমেছে আ. লীগ

By Daily Satkhira

April 29, 2017

ডেস্ক: দলকে সংগঠিত করতে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য আগাম মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, অন্তঃকোন্দল নিরসন এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ একসঙ্গে চালাচ্ছেন তারা।

বিভেদ নিরসনের জন্য গত এক সপ্তাহে পাঁচটি জেলার শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে বৈঠক করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এর বাইরে দুই দলে ভাগ করে ঢাকা ও এর আশপাশের সাতজন দলীয় সাংসদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন ওবায়দুল কাদের। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম ও সিলেটে গিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।

দলীয় সূত্র বলছে, সময়ের আগে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়লেও যাতে দল প্রস্তুত থাকে—আগাম নির্বাচন প্রস্তুতি শুরুর এটাও একটা লক্ষ্য। এ ছাড়া বিএনপিকেও বিভ্রমে ফেলতে চায়, যাতে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আন্দোলনের চিন্তা করবে, নাকি ভোটের প্রস্তুতি নেবে, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে সবকিছু সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণেই আছে। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও খুবই দুর্বল। তারপরও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা শঙ্কা রয়েছে। সেটা হলো, বিএনপি নির্বাচনে এলে শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যাবে কি না। যার কারণে আগেভাগে দলকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি ইসলামিক দল ও সংগঠনগুলোর মন জয় করার চেষ্টাও করছে সরকার, যাতে ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বিএনপি ব্যবহার করতে না পারে।

বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষে নির্বাচন হলে এখনো সময় বাকি প্রায় পৌনে দুই বছর। অবশ্য গত ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে ভোট চাইছেন। একই সময় থেকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সারা দেশে কর্মিসভা, প্রতিনিধি সভা ও রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করছেন। ২৩ এপ্রিল থেকে কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও নীলফামারী জেলার নেতাদের ঢাকায় এনে বৈঠক করেন ওবায়দুল কাদের।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে তৎপর এমন একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হলে জয় পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। সর্বশেষ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশনে বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হন। এরপর জাতীয় নির্বাচন বিএনপি জোট বর্জন করার কারণে আওয়ামী লীগকে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়নি।

ওই নেতা আরও বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পাঁচ পর্বের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নেয় এবং প্রথম দুই পর্বের ফলাফলে তারা এগিয়ে থাকে। পরের পর্বগুলোতে ‘যেকোনো মূল্যে এগিয়ে যাওয়ার’ কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। গত দুই বছর পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও একই পন্থা অবলম্বন করা হয়। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি প্রভাব ছাড়াই জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। এই অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতটা ভালো ফল করতে পারবে, তা নিয়ে কিছু দুচিন্তা আছে।

আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংসদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়তে হতে পারে তাদের। তারা নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের সাংসদের সংখ্যা ২৩৪। ১৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ওই নির্বাচনে যে ১৪৭টি আসনে ভোট হয়েছে, তাতে সব দল মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন ৩৯০ জন। ফলে বৈধ ভোটের ৭২ শতাংশের বেশি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র সাংসদেরা মিলে পেয়েছেন ১৫ শতাংশ। আগামী নির্বাচন এমনটা না-ও হতে পারে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা নিরঙ্কুশ বিজয় চাই। এ জন্যই আগেভাগে প্রস্তুতি শুরু করেছি। আমরা যে উন্নয়ন করেছি, এগুলো মানুষকে জানাতে সময় দরকার। আমরা আমাদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য কাজ করছি।’

এদিকে ঘর গোছানোর মাধ্যমে নির্বাচন প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে আওয়ামী লীগের সাংসদদের অনেকের মধ্যে বাদ পড়ার আতঙ্ক কাজ করছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা, সাংসদ ও মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫০ জনের বেশি বর্তমান সাংসদ আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়তে পারেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংখ্যাটা ৭০ ছাড়িয়ে যাবে। এই অবস্থায় সাংসদদের মধ্যে কে থাকছেন, আর কে বাদ পড়ছেন, সেই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে দলের নেতাদের মধ্যে।

গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে ঢাকার মিরপুরের তিন সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার, আসলামুল হক ও ইলিয়াস মোল্লাহকে নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত মঙ্গলবার ঢাকার আশপাশের চারজন সাংসদকে নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। এসব বৈঠক আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বৈঠকে অংশ নেওয়া সাংসদদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী কে হতে পারেন, দলে আর কেউ মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন কি না এবং সাংসদের সঙ্গে দলের নেতাদের দূরত্ব কতটুকু—এগুলোই মূলত জানার বিষয় ছিল।

মঙ্গলবারের বৈঠকে অংশ নেওয়া সাভারের সাংসদ এনামুর রহমান বলেন, বৈঠকে অংশ নিয়ে তার মনে হয়েছে, তিনি ভবিষ্যতেও মনোনয়ন পাবেন। ছোটখাটো ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। ধামরাইয়ের সাংসদ আবদুল মালেক বলেন, কে বাদ যাবে আর কে থাকবে, সেটা তো এখনই বলার সময় আসেনি। তবে দল থেকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এই বৈঠকে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা-২ আসনের (কেরানীগঞ্জ ও সাভারের একাংশ) সাংসদ। তিনি বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। সেখানে কার কী সমস্যা, তা জেনেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এর মধ্যে মনোনয়নের কোনো বিষয় নেই।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও ৬ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৯ জন বাদ পড়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ বাদ পড়েন বয়সের কারণে। কারও কারও বিরুদ্ধে ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। আগামী নির্বাচনেও কিছু প্রবীণ নেতা মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন। আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোনো রকম বড় অপারেশনে না গেলেও নির্বাচনে আগেরবারের ১৫-২০ শতাংশ মন্ত্রী-সাংসদ বাদ পড়ে যান। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনটি যেহেতু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি, তাই আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হলে বড় অপারেশনই চলতে পারে।’

দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জরিপ-সমীক্ষার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ জন্য ইতিমধ্যে কয়েকটি জরিপ করা হয়েছে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় পরপর জরিপ-সমীক্ষা চলবে। ফলে সাংসদদের অনেকে উদ্বেগে আছেন। অনেকে নিজ এলাকায় যাওয়া বাড়িয়েছেন।

ময়মনসিংহ জেলার একজন সাংসদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিরোধী দল মাঠে নেই। তাই সরকারি দলের কিছু কিছু নেতা-কর্মী বেপরোয়া হয়ে যান, যার দায় সংশ্লিষ্ট সাংসদের ওপরই পড়ছে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন ঠিক করার ক্ষেত্রে দল জনপ্রিয়তা ছাড়া আর কী কী বিষয় বিবেচনায় নেবে, সেটা বুঝতে পারছেন না। ফলে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে। তবে এখনো কাটিয়ে ওঠার সময় আছে বলে তিনি মনে করেন। চট্টগ্রাম বিভাগের একজন সাংসদ বলেন, তিনি এখন এলাকাতেই বেশি থাকছেন। কিন্তু দলীয় কোন্দল একটা বড় সমস্যা। তিনি বলেন, জরিপ-সমীক্ষা সব সময় ঠিক হয় না। এ কারণে তারা কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছেন।

জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের গত রোববার বলেন, মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, দলের সবাইকে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় নেওয়া হবে। অনেককেই উন্নতি করার জন্য বলা হয়েছে। এর মধ্যে উন্নতি করতে না পারলে বাদ যাবেন।