বিদেশের খবর : পুলিশি নির্যাতনে বাবা ও ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের তামিলনাডু। রাজ্যটিতে লকডাউন চলছে। এ বিধি নিষেধে নির্ধারিত করা হয়েছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সময় সূচি। এমন অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় দোকান খোলা রাখার অপরাধে ৫৪ বছরের বাবা পি জয়রাজ ও ৩৮ বছরের ছেলে ইম্যানুয়েল ফেনিক্সকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় পুলিশ।
বিবিসি জানিয়েছে, দুইজনকে পুরো রাত পু্লিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে। দুইদিন পরে একে অপরের কয়েকঘণ্টা ব্যবধানে মারা যান। নিহতের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছে, পুলিশের বর্বরোচিত নিপীড়নে তাদের মৃত্যু হয়।
কলকাতার সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, ১৯ জুন লকডাউনের মধ্যে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দোকান খুলে রেখেছিলেন পি জয়রাজ ও ফেনিক্স। পি জয়রাজ পেশায় কাঠের ব্যবসায়ী। ইম্যানুয়েল একটি মোবাইলের দোকান চালাতেন তুতিকোরিন এলাকায়। সন্ধ্যায় বাবা-ছেলে ওই দোকানে ছিলেন। রাত ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে দোকানের বন্ধ করতে যান জয়রাজ। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর কেন দোকান বন্ধ করা হচ্ছে, তা নিয়ে এলাকায় টহল দেওয়া পুলিশকর্মীদের সঙ্গে তার তর্ক হয়। ইম্যানুয়েলও সেই তর্কে জড়িয়ে যান। কিছুক্ষণ পর বিষয়টি মিটে যায়। দু’জনে বাড়ি ফিরে যান।
পরের দিন রাত পৌনে ৮টার দিকে একদল পুলিশকর্মীকে নিয়ে দোকানে হাজির হন স্থানীয় সাথানকুলাম থানার সাব ইনস্পেকটর বালকৃষ্ণ। সেই সময় দোকানে জয়রাজও উপস্থিত ছিলেন। আগের দিনের ঘটনা নিয়ে নতুন করে তর্ক শুরু হয়। এর পরেই জয়রাজকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয় পুলিশ। এক বন্ধুর সঙ্গে দোকানের ভেতর দিকে ছিলেন ইম্যানুয়েল। বাবাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আটকাতে যান। কিন্তু তাকে থানায় আসতে বলে জয়রাজকে নিয়ে চলে যায় পুলিশের গাড়ি।
এর পর পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে আইনজীবী নিয়ে থানায় পৌঁছেন ইম্যানুয়েল। কী অপরাধে তার বাবাকে থানায় আনা হয়েছে, তা পুলিশের কাছে জানতে চান তিনি। সদুত্তর না পেয়ে পুলিশের সঙ্গে ফের তর্ক শুরু হয়। এর জেরে তাকেও হাজতে পোরার নির্দেশ দেয় পুলিশ। ইম্যানুয়েলের এক বন্ধু রাজেশ সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেন, তাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে কয়েক জন পুলিশকর্মী হাজতের মধ্যে ইম্যানুয়েল ও তার বাবাকে বেধড়ক মারধর করেন। মাঝ রাত পর্যন্ত লাঠি দিয়ে তাদের পেটাতে থাকে পুলিশ। ভোররাতের দিকে আইনজীবী ও ইম্যানুয়েলের বন্ধুদের পুলিশ থানা থেকে চলে যেতে বলে।
ইম্যানুয়েলের বন্ধুদের দাবি, ২১ জুন সকালে ফের আইনজীবী নিয়ে থানায় হাজির হয়ে তারা জানতে পারেন, জয়রাজ ও ইম্যানুয়েলের বিরুদ্ধে কয়েকটি ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় বাবা-ছেলেকে তারা থানায় দেখতে পান। ইম্যানুয়েলের আইনজীবী এস মণিমারন জানান, হাজতের যেখানে জয়রাজ ও ইম্যানুয়েলকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেই জায়গাটা রক্তে ভেজা ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতে তাদের বসার আসনের উপর কম্বল পাতা হয়েছিল। কিন্তু বাবা-ছেলের শরীর থেকে এত রক্ত বেরোচ্ছিল যে, সেই কম্বলটাও ভিজে যায়। তার মক্কেলরা জানিয়েছেন, হাজতের ভেতর মারধরের পাশাপাশি তাদের মলদ্বারে লাঠি ঢুকিয়ে অত্যাচার চালায় পুলিশ। ছেলের পিঠ থেকে খুবলে মাংস তুলে নেওয়া হয়। দু’জনের বুকে রোম ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ইম্যানুয়েলের শরীরের একাধিক জায়গা থেকে চামড়া তুলে নেওয়া হয়। জয়রাজ ও তার ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখেও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাদের দু’জনকেই ‘ফিট সার্টিফিকেট’ লিখে দেন। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে থাকাকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বাবা-ছেলেকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আর্জি জানায় পুলিশ। দু’জনকে না দেখেই তাতে অনুমতি দেন ম্যাজিস্ট্রেট।
আইনজীবীর দাবি, হাসপাতাল থেকে কোভিলপট্টি উপ সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয় জয়রাজ ও তার ছেলেকে। তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে সন্ধ্যায় কোভিলপট্টি হাসপাতালে পাঠানো হয় দু’জনকে। সোমবার সন্ধ্যায় বুকে ব্যথা শুরু হয় ইম্যানুয়েলের। রাতে ওই হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তার। মঙ্গলবার সকালে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার পর মারা যায় জয়রাজও।
হাসপাতাল থেকে বাবা-ছেলের দেহ নিতে অস্বীকার করেন তাদের পরিবারের লোকজন। যতক্ষণ না পুলিশের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের হচ্ছে, ততক্ষণ দেহ সৎকার করবেন না বলে জানিয়ে দেন তারা। মাদ্রাজ হাইকোর্ট বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিলে দেহ সৎকার করেন তারা।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই পথে নেমে পড়ে জনতা। মঙ্গলবার সাথানকুলাম থানার সামনে অনশনে বসেন কয়েকশ মানুষ। বুধবার তুতিনকোরিনের সব দোকান বন্ধ রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
পুলিশের এই আচরণের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে এআইএডিএমকে সরকার। রাজ্য সরকারকেই এর দায় নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন। দলের আইনপ্রণেতা কানিমোঝি দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানিয়েছেন। সিবিআইকে গোটা ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হোক বলে দাবি তুলেছে কংগ্রেস।
পুলিশের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, ‘পুলিশি নৃশংসতা এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। দুঃখের বিষয়, যে পুলিশ আমাদের রক্ষাকর্তা, এখানে তারাই উৎপীড়নকারী।’
এদিকে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে কাজ করা একটি এনজিও ২০১৯ সালে পুলিশি হেফাজতে আটক ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ওই সংস্থাটির হিসাব মতে, দেশটিতে গত বছর ১৭৩১ জন পুলিশি হেফাজতে প্রাণ হারান। একদিনে সর্বোচ্চ পাঁচজন পু্লিশি হেফাজতে মারা গেছেন। প্রতিবেদনে নির্যাতনের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কেও বর্ণনা করা হয়েছে। এত সব ঘটনায় মাধে মধ্যে জবাবদিহিতার মুখে পড়ায় বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়েও তারা (পুলিশ) বিব্রতকর মন্তব্য করেছে।