অনলাইন ডেস্ক : জ্যামিতিক হারে বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। একদিন আক্রান্তের রেকর্ড হচ্ছে, তো আরেকদিন মৃত্যুর। গত সোমবার ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ চার হাজার ১৪ জন। আর গতকাল মঙ্গলবার একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হলো।
এর আগে গত ১৬ জুন একদিনে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেটিই ছিল এর আগ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ৮৪৭ জনে পৌঁছাল। একই সঙ্গে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিন হাজার ৬৮২ জনের শরীরে নতুন করে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছাল এক লাখ ৪৫ হাজার ৪৮৩ জনে। সংক্রমণের গতি এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, কেবল জুন মাসেই দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছেন। এযাবৎ মোট আক্রান্তের প্রায় ৬৮ শতাংশ এবং মৃত্যুর প্রায় ৬৫ শতাংশই ঘটেছে গত এক মাসে। আর এই চিত্র সামনের দিনগুলোর জন্য মহাবিপদ সংকেত বহন করছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে দেখা যায়, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজনের মৃত্যু হয়। সংক্রমণের হিসাবে গতকাল ছিল ১১৪তম দিন। এই সময়ে দেশে মোট আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৪৫ হাজার ৪৮৩ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন এক হাজার ৮৪৭ জন।
করোনা সংক্রমণের ৮৪তম দিনে গত ৩১ মে পর্যন্ত ৪৭ হাজার ১৫৩ জন আক্রান্ত হন। ওই সময় পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৬৫০। পরের ৩০ দিনে অর্থাৎ পুরো জুনে আক্রান্ত হয়েছেন ৯৮ হাজার ৩৩০ জন এবং মারা গেছেন এক হাজার ১৯৭ জন। অর্থাৎ মোট সংক্রমণের ৬৭ দশমিক ৫৮ শতাংশই হয়েছে এই সময়ে। মোট মৃত্যুর ৬৪ দশমিক ৮০ শতাংশও হয়েছে এই সময়ের মধ্যে। জুন মাসে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার ২৭৮ জন করে আক্রান্ত এবং ৩৯ দশমিক ৯ জন করে মৃত্যুবরণ করেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমানে করোনা সংক্রমণের পিকটাইম চলছে। এ জন্য সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে এই সময়ে। জুলাই মাসেও এটি অব্যাহত থাকবে। আগস্টে গিয়ে এটা কমে আসবে। তবে এ ক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অন্যথায় আগস্টেও করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
জুলাইয়েও উচ্চ সংক্রমণ থাকবে :
চলমান পরিস্থিতিতে করোনায় দেশে আরও কত মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করতে পারেন, তা নিয়ে জুনের মাঝামাঝি একটি পর্যালোচনা করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জনস্বাস্থ্যবিদদের নিয়ে গঠিত তাদের আট সদস্যের কমিটির ওই পর্যালোচনায় দেখা যায়, সংক্রমণের চলমান ঊর্ধ্বমুখী ধারা জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সময়ে আরও এক লাখ ২৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। আগস্ট মাসে সংক্রমণের মাত্রা নিম্নমুখী হতে শুরু করবে। বর্তমানে মৃত্যুহার রয়েছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা বেড়ে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৯০ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই কমিটির প্রধান ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন গতকাল বলেন, দেশে বর্তমানে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ বা পিকটাইম চলছে। জুলাই মাসজুড়ে সংক্রমণের এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এই সময়ে আরও এক লাখ ২৫ হাজারের মতো মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এরপর আগস্টে গিয়ে সংক্রমণ নিম্নমুখী হতে শুরু করবে। এভাবে ধাপে ধাপে সংক্রমণের মাত্রা হ্রাস পেতে থাকবে। ডা. শাহ মনির হোসেন আরও বলেন, এই পূর্বাভাসের বাস্তবতা কিংবা কার্যকারিতা নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। অর্থাৎ সরকার জোনভিত্তিক যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে এই পূর্বাভাস হয়তো মিলবে। সেটা না হলে এই পূর্বাভাস কাজে আসবে না। তখন সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই আবার বাড়বে। কার্যকর লকডাউন, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে অবস্থান করলেই কেবল আগস্টে গিয়ে সংক্রমণের মাত্রা নিম্নমুখী হবে। কিন্তু এগুলো মেনে না চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। একই অভিমত ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ চলছে। অন্যদিকে সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশের কয়েকটি রেড জোনে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলেও সর্বোচ্চ সংক্রমিত রাজধানী ঢাকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে এখনও কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পূর্ব রাজাবাজার ও ওয়ারীর রেড জোনে কার্যক্রম শুরু হলেও পুরো রাজধানী এখনও অরক্ষিত। এভাবে চললে আগস্টেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে চাইলে রেড জোন চিহ্নিত করে দ্রুত লকডাউন কার্যকরের পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।
জোরালো প্রস্তুতির তাগিদ বিশেষজ্ঞদের :
করোনা মোকাবিলায় সরকার যে প্রস্তুতি নিয়েছে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, জুনের প্রথম সপ্তাহে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকরের কথা বলা হলেও মাঠে তার বাস্তবায়ন ছিল না। এই সময়ে এক লাখের কাছাকাছি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। চলমান পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ চলছে শম্বুকগতিতে। এতে করে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, করোনা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কোনো কিছুই তারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ভাইরাসটি প্রতিরোধে দ্রুততম সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না। দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন- এই তিন জোনে ভাগ করে কার্যক্রম গ্রহণের কথা জুনের প্রথম দিন বলা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত কাজটি সেভাবে করা যায়নি। এই সময়ের মধ্যে প্রায় এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হলেন। কয়েকটি এলাকায় জোনভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হলেও অধিক সংক্রমিত ঢাকায় কোনো খবর নেই। এভাবে তো ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করা যাবে না। ভাইরাস প্রতিরোধ করতে হলে তার আগে ছুটতে হবে। পেছনে ছুটে ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দ্রুততম সময়ে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যক্রম গ্রহণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মনে করেন তিনি।
চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ মনে হয় ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের সব উপায় হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে কোনো কার্যক্রম ও তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। লকডাউনেরও খবর নেই। হাসপাতাল প্রস্তুতির কোনো কার্যক্রমও নেই। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, তাদের যা করার ছিল সবকিছু করেই ফেলেছে। নতুন করে আর কিছু করা হবে না। আতঙ্ক কিন্তু বাড়ছে। জানি না, এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়। আর স্বাস্থ্য বিভাগই বা কী করতে চাইছে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন :
করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত চব্বিশ ঘণ্টায় আরও এক হাজার ৮৪৪ রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে মোট ৫৯ হাজার ৬২৪ জন সুস্থ হলেন। দেশের ৬৬টি পরীক্ষাগারে গত চব্বিশ ঘণ্টায় ১৮ হাজার ৪২৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে সাত লাখ ৬৬ হাজার ৪০৭টি নমুনা। চব্বিশ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। শনাক্তের সংখ্যা বিবেচনায় সুস্থতার হার ৪০ দশমিক ৯৮ শতাংশ ও মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। ডা. নাসিমা সুলতানা আরও বলেন, চব্বিশ ঘণ্টায় মৃতদের মধ্যে ৫২ জন পুরুষ এবং ১২ জন নারী। ৫১ জন হাসপাতালে এবং ১৩ জন বাড়িতে মারা গেছেন। যারা মারা গেছেন তাদের তিনজনের বয়স ছিল ৮০ বছরের বেশি। ১১ জনের বয়স ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে, ১৬ জনের বয়স ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে, ২১ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ছয়জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং সাতজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। মৃত ৬৪ জনের মধ্যে ৩১ জন ঢাকা বিভাগের, ১২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, সাতজন করে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের এবং দু’জন করে সিলেট, বরিশাল বিভাগের ও ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, চব্বিশ ঘণ্টায় আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে ৪৪৯ জনকে। এখন পর্যন্ত মোট আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৫৮৭ জনকে। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ১৪ হাজার ১৪৫ জন। আইসোলেশন থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় ৫৪৪ জন এবং এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৪৪০ জন ছাড়া পেয়েছেন। একই সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইন মিলে কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে দুই হাজার ৫৪২ জনকে। এখন পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে তিন লাখ ৬৩ হাজার ৮৬৬ জনকে। কোয়ারেন্টাইন থেকে গত চব্বিশ ঘণ্টায় দুই হাজার ৮৩৪ জন এবং এখন পর্যন্ত মোট দুই লাখ ৯৯ হাজার ১৯৯ জন ছাড়া পেয়েছেন। বর্তমানে মোট কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৬৪ হাজার ৬৬৭ জন। সূত্র: সমকাল