অনলাইন ডেস্ক : ‘করোনা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা এবং বাড়িতে থাকা রোগীদের করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করত রিজেন্ট হাসপাতাল। এছাড়াও সরকার থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ টেস্ট করার অনুমতি নিয়ে রিপোর্ট প্রতি সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে আদায় করত তারা। এভাবে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে মোট ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। এই সমস্ত অপরাধ ও টাকার নিয়ন্ত্রণ চেয়ারম্যান সাহেব (রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহেদ) নিজে করত।’
সোমবার (৬ জুলাই) উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। তিনি অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
সারোয়ার আলম বলেন, ‘অনিয়ম, অপরাধ ও প্রতারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চেয়ারম্যান নিজেই ডিল করেছেন, অন্যান্য কয়েকজন কর্মীও ছিল। চেয়ারম্যান পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হবে, জড়িত সবাইকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।’
অভিযানে রিজেন্টের ৮ জন কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে। তাদের নাম-পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
রিজেন্টের অনিয়ম-অপরাধ ও প্রতারণা:
অভিযানের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কয়েকটি অনিয়ম ও প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছি আমরা। প্রথমত, করোনা টেস্টের জন্য আসা রোগীদের বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করার কথা ছিল রিজেন্টের। কিন্তু আমরা দেখলাম তারা প্রায় ১০ হাজার জনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে, প্রত্যেকের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এসব নমুনার অর্ধেকের বেশি পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ প্রতারণা।
তিনি আরও বলেন, রিজেন্ট সরকারকে জানিয়েছে তারা কোভিড-রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দিচ্ছে। এই বলে তারা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ক্লেইম করেছে। অথচ অনেক রোগীর কাছ থেকেও তারা দেড় লাখ-দুই লাখ, আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত বিল আদায় করেছে বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি।
সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্টকে কোভিড হাসপাতালের এই অনুমতি দেয়ার আগে শর্ত ছিল এখানে যারা ভর্তি হবেন, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআইআর, জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট থেকে ফ্রি অব কস্ট (বিনামূল্যে) পরীক্ষা করাবে। আর রিজেন্ট বাসায় বাসায় গিয়ে ১০ হাজারের বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ২৬৪ জনের নমুনা আইইডিসিআরসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে টেস্ট করিয়েছে। বাকি নমুনাগুলো টেস্ট না করে ভুয়া রিপোর্ট করেছে। আমরা আইইডিসিআরে রিপোর্ট ক্রসচেক করে দেখেছি, রিজেন্ট এগুলো তাদের পাঠায়নি। ভুয়া রিপোর্টের জন্য সাড়ে তিন হাজার করে টাকা নিয়েছে। আমরা দেখলাম এ পর্যন্ত সে ৩ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়গুলো চেয়ারম্যান নিজে ডিল করেছে, অন্যান্য কয়েকজন কর্মীও ছিল।
অপরাধ ধামাচাপা দিতে রিজেন্টের অভিনব কৌশল:
গত কয়েকদিন ধরে এই অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে আসতে থাকলে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে নতুন কৌশল নেয় রিজেন্ট। অভিনব এই কৌশলের বিষয়ে সারোয়ার আলম বলেন, যখন আমরা বিভিন্নজনের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পাচ্ছিলাম তখন রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ এটাকে গোপন করার জন্য গত পরশু একটা প্রেস কনফারেন্স করে। সেখানে তারা বলে, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসবের জন্য দায়ী না। রিজেন্ট হাসপাতালের ৩ জন কর্মী এর সঙ্গে জড়িত।’
সারোয়ার আলম বলেন, নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে গতকালকে (রোববার) ১ মাস ৭ দিন আগের ব্যাকডেট দিয়ে ৩ কর্মচারীকে বরখাস্ত করে রিজেন্ট। তাদের বিরুদ্ধে থানায় একটা সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে রিজেন্ট। অথচ আমরা দেখলাম ওই ৩ কর্মী গত দেড়মাস অফিস করেছে, হাজিরা দিয়েছে। রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ ফ্লুইড দিয়ে তাদের হাজিরা খাতার স্বাক্ষরগুলো মুছে দিয়েছে, যাতে সে প্রমাণ করতে পারে যে আগেই তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। শুধু তাই না, রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ এই ৩ কর্মচারীদের বলেছে যে, ‘আপনারা চাকরি করেন কোনো সমস্যা নেই, আমরা আপনাদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসব।’ তার মানে কর্তৃপক্ষ স্টাফদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার চেষ্টা করেছে। এই সমস্ত অপরাধ ও টাকার নিয়ন্ত্রণ চেয়ারম্যান নিজে করত।
লাইসেন্স ছিল না, তবু কেন কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতালের অনুমতি?
লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার পরেও কেনো রিজেন্ট হাসপাতালকে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়? এমন এক প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার আলম বলেন, ক্রাইসিস মুহূর্তে যখন একটি বেসরকারি সংস্থা বিনামূল্যে সেবা দিতে চাইবে সরকার অবশ্যই তাদের ওয়েলকাম করবে। সরকার তাই করেছে। লাইসেন্সের চেয়ে মুখ্য ছিল সেবা দেয়া।
এই ঘটনা বিশ্বে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে:
ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ এই ইতিহাস তৈরি করেছে বলে আমার জানা নেই। আমার ধারণা একমাত্র বাংলাদেশেই এই সমস্ত কিছু লোক টেস্টের নামে আমাদের দেশকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা আশা করছি এই অপরাধের কারণে তাদের মারাত্মক শাস্তি হবে। আমরা চাই না এই কোভিড-১৯ নিয়ে কেউ কোনো প্রতারণার আশ্রয় নিক। এ অপরাধের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শাহেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদসহ বেশকিছু কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। এ কারণে আমরা ৮ জনকে আটক করেছি। তাদেরসহ জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নিয়মিত ধারায় মামলা করা হবে। তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসব।