করপোরেট সাংবাদিকতা, বিজ্ঞাপন, কর্তৃপক্ষের স্বার্থরক্ষার সাংবাদিকতার বাইরে মুক্ত সাংবাদিকতার অঙ্গীকার ধরে রাখার প্রচেষ্টায় বুধবার (৩ মে) বিশ্বব্যাপী পালন করা হবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ক্রান্তিকালে সমালোচকের দৃষ্টি: শান্তিপূর্ণ, ন্যায়নিষ্ঠ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা’।
১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশে জাতিসংঘ ১৯৯৩ সাল থেকে এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো দিবসটি পালন করলেও গণমাধ্যম কতটা মুক্ত তা নিয়ে ওঠা প্রশ্নের সমাধান হয়নি আজও। গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বাস্তবায়ন এখনকার সময়ে আর পুরোটা সম্ভব নয়।’
প্রসঙ্গত, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে গত ২৬ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পিকেটারদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহে থাকা এটিএন নিউজের প্রতিবেদক এহসান বিন দিদার ও ক্যামেরা পারসন আব্দুল আলীমকে দুপুরের দিকে শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে মারধর করে পুলিশ। কেবল এ ঘটনাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাজমুলকে আটক করে একের পর এক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল-১৯-এর ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৪’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশ, র্যা ব ও গোয়েন্দাদের হাতে।
এদিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন উপলক্ষে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন পৃথকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে এমন এক সময়ে এবার মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হচ্ছে যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার শঙ্কায় কী লেখা যাবে আর কী লেখা যাবে না তা সমাধান হয়নি। নতুন এই আইনটি অনলাইন সাংবাদিকতার জন্য কতটা হুমকি বা কতটা নিরাপদ সেই আলাপের মধ্যে সময় কাটছে। অভিযোগ আছে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর প্রতিও।
যদিও তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, সার্বিকভাবে গত আট বছরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সুবিশাল কর্মযজ্ঞে দেশে গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। পিআইডি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গণমাধ্যমের উন্নয়নে এ সময়ে নতুন ১৬৪৭টি পত্রিকা নিবন্ধিত হয়েছে; বেসরকারি খাতে নতুন ৩৬টি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদনসহ ২৪টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিওকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষান্মাষিক মিলে মোট পত্রিকার সংখ্যা ২৮৫৫টি। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্র নিয়ে সরকারি ৪টি ও অনুমোদনপ্রাপ্ত ৪৪টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে ২৬টি সম্প্রচাররত; পাশাপাশি সম্প্রচারিত হচ্ছে ২১টি এফএম রেডিও ও ১৭টি কমিউনিটি রেডিও। এছাড়া সংবাদপত্রকে ঘোষণা করা হয়েছে শিল্প হিসেবে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মীর আকরাম উদ্দীন আহম্মদ পিআইডি প্রতিবেদনের মাধ্যমে বলেন, ‘দেশের উন্নয়নকে টেকসই, গতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক করতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কোনও বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারের এই অন্যতম মূলমন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করছে তথ্য মন্ত্রণালয়। উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় সেই কাজেরই অংশ।’
সরকারকেই স্বাধীন গণমাধ্যম তৈরির পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তার মতে, এটা সরকারের দায়িত্ব। কারণ এর কাঠামোগত ক্ষমতা সরকারের কাছেই আছে। মঙ্গলবার (২ মে) টিআইবি’র মেঘমালা সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘এসডিজি-১৬ ও সুশাসন: সরকার, গণমাধ্যম ও জনগণ’ শীর্ষক এক সংলাপে তিনি এ মন্তব্য করেন।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গণমাধ্যম আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান কাঠামো তৈরি করা আছে যেখানে গণমাধ্যমের ওপর ক্রমাগতভাবে চাপ বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা বিকাশের অন্তরায়। এই চাপের কারণে অনেকের মাঝে স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ বিরাজ করছে। সুষ্ঠু সাংবাদিকতা করার চেষ্টা রয়েছে এমন অনেকের মধ্যেও এর প্রভাব দেখা যায়।’
এদিকে করপোরেট যুগে সাংবাদিকতা কতটা মুক্ত, এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন তুলনামুলক মুক্ত। তবে পরিপূর্ণ মুক্ত হতে পারেনি। সংকটের জায়গা হলো, গণমাধ্যম মুক্ত নয়। এর কারণ বিভিন্ন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির হাতে গণমাধ্যমের চলে যাওয়া। মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড স্বাধীন হতে হবে যেমন, তেমনই যারা গণমাধ্যমের সঙ্গে আছে তাদের পেশা ও জীবনের নিরাপত্তা থাকতে হবে যা এখনও অর্জিত হয়নি।’