নিজস্ব প্রতিনিধি : ঘরের চালে ঢিল ছোঁড়ার অভিযোগে কওমী মাদ্রাসার এক ছাত্রকে ডেকে নিয়ে আটক করার পর তার শরীরে আলকাতরা মাখানোর অভিযোগে দু’টি বাড়ি, একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পোল্ট্রি ফার্মে হামলা চালানো হয়েছে। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার তেতুলিয়া পশ্চিমপাড়ার কোহিনুর বেগম ও তার মেয়ে রোজিনার বাড়িতে তেতুলিয়া হামিইউছুনুর কওমি মাদ্রাসা ও হাফেজখানার ছাত্র ও স্থানীয় কয়েককটি গ্রামের প^াঁচ শতাধিক মানুষ এ সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ভাঙচুর ও লুটপাটে বাধা দেওয়ায় ওই পরিবারের ছয়জনসহ ১০জন আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন, তেতুলিয়া পশ্চিমপাড়ার গ্রাম পুলিশ রুহুল আমিনের মেয়ে কোহিনুর বেগম, তার মেয়ে রোজিনা, রোজিনার ছেলে ইমরান, রুহান, একই পাড়ার মরিয়ম, মোসলেমা, নাছিমা ও রানী, সামছুর রহমান ও রিঙ্কু। এদের মধ্যে কোহিনুরকে আশাঙ্কাজনক অবস্থায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও অন্যদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তেতুলিয়া পশ্চিমপাড়ার খোলপেটুয়া নদীর চরের বাসিন্দা কোহিনুর বেগম জানান, তেতুলিয়া ব্রীজের পাশের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম সরদারের ছেলে নজরুল ইসলাম(১৫) তেতুলিয়া হামিইউছুনুর কওমি মাদ্রাসা ও হাফেজখানার নজরান বিভাগে পড়াশুনা করে। শুক্রবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে নজরুল তাদের বাড়ির পিছনে যেয়ে তার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে। সাড়া না পাওয়ায় ঘরের চালে ইট ছুঁড়ে মারে। একপর্যায়ে ছাদে উঠে মেয়ে রোজিনা বাড়ির পিছনের রাস্তায় নজরুলকে দেখতে পায়। জরুরী দরকার আছে বললে মেইন গেট খুলে দেওয়া হয়। এ সময় সে ঘরের মধ্যে এসে রোজিনার কাছে থাকতে চায়। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুলকে আটক করেন।পরে তার হাতে ও মুখে আলকতারা মাখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোহিনুর ইসলাম আরো জানান, মাদ্রাসার ঘাট থেকে নজরুলকে ডেকে এনে তার উপর অত্যাচার করা হয়েছে বলে মাদ্রাসার ছাত্ররা এলাকায় প্রচার দেয়। একপর্যায়ে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে একই গ্রামের শহীদুল সরদারের ছেলে মাদক ব্যবসায়ি রুবেল, রবিউলের ছেলে নজরুল, জাহেদ সরদারের ছেলে আরিফুল ও রফিকুল শুকুর আলী সরদারের ছেলে মাসুম, রফিকুল সরদারের ছেলে রবিউল, কাদের গোলদারের ছেলে আলাউদ্দিন, আশরাফ আলীর ছেলে ইসমাইল, শুকুর ফকিরের ছেলে আব্দুল আজিজ, শাহজালালের ছেলে আব্দুল্লাহ, গোলাম রসুল গোলদারের ছেলে সোলায়মান, আনছার সরদারের ছেলে মোস্তফা, ছাদেক সরদারের ছেলে তারিকুল ইসলামসহ পার্শ্ববর্তী ৭/৮টি গ্রামের চার থেকে ৫০০ লোক হাতে চাইনিজ কুড়াল, লোহার রড, দা, শাবল, বাঁশের লাঠি ইত্যাদি নিয়ে ‘নারয় তকবির , আল্লাহ হু আকবর ’ স্লোগান দিতে দিতে তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা বাড়ি সংলগ্ন মুদি দোকানের শার্টার, মেইন গেটের তালা, ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে। একে একে তারা চারটি বসত ঘর, একািট রান্না ঘর ও বাথরুমের দরজা ভেঙে ফেলে। দোতালার সিড়িঘরের দরজাও তারা ভেঙে ফেলে। এ সময় তারা ঘরের মধ্যে থাকা একটি রেফ্রিজারেটর, দু’টি পানির ট্যাঙ্ক, একটি ৫০ ওয়াটের সোলার প্লেট, একটি বৈদ্যুতিক মিটার, দু’টি ড্রেসিং টেবিল, চারটি শোকেজ, একটি বেসিন, একটি আলমারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র, ঘরের চাল, ছাদের অংশ বিশেষ ভাঙচুর করে। এ সময় হামলাকারিরা তাদের পোল্ট্রি ফার্মটিও ভাঙচুর করে। হামলাকারিরা তাদের বাড়ি থেকে, নগদ টাকা ও সোনার গহনাসহ দু’ লক্ষাধিক টাকার মালামালা লুট করে নিয়ে যায়। ভাঙচুর করা হয় তিন লক্ষাধিক টাকার জিনিপত্র। লুটপাট ও ভাঙচুরে বাধা দেওয়ায় তাকে (কাহিনুর) এলোপাতাড়ি পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করা হয়। তাকে রক্ষায় এগিয়ে এলে রোজিনা, তার দু’ ছেলে, মরিয়মসহ ১০ জন জখম হয়। সরেজমিনে শুক্রবার দুপুরে তেতুলিয়া গ্রামে গেলে গ্রাম পুলিশ রুহুল আমিন, রাফিজউদ্দিন, রিঙ্কু, মুজিবর সানা, রফিকুল সানা, আশরাফুল ইসলাম ও মোসলেম আলী জানান, শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ হামলা চলে। খবর পেয়ে আশাশুনি থানার উপপরিদর্শক জিল্লুর রহমান, জুয়েল, জাহাঙ্গীর, সাঈদ,সহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। সকাল ১১টার দিকে তারা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র, ব্রাহ্মন তেতুলিয়া, মিত্র তেতুলিয়া, তেতুলিয়া, ফকরাবাদ, ও মোকামখালি থেকে আসা কয়েক’শ জামায়াত সন্ত্রাসীকে পুলিশ থামানোর চেষ্টা করলে তাদেরকেও ধাওয়া করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ভাঙচুর, লুটপাট ও মারপিটের দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করার চেষ্টা করলে বাধা দেয় সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে দেবহাটা সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার ইয়াছিন আলী, আশাশুনি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কবীরের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে হামলাকারিরা চলে যায়। পুলিশ আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে। তারা জানান, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের পরবর্তী জামায়াতের তাণ্ডব তারা শুক্রবার দেখেছেন। এদিকে রবিউল ইসলামের ছেলে নজরুল ইসলাম বলে সে শুক্রবার ভোরে অজু করার জন্য মাদ্রাসার পুকুর ঘাটে যায়। বাড়ি থেকে ডাক দিয়ে ঘরের চালে ঢিল মারার অভিযোগে তাকে কোহিনুর নানী আটকে রেখে সারা গায়ে আলকাতরা মাখিয়ে দেয়। বিষয়টি সে ও তার পরিবারের সদস্যরা ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীকে জানান। একপর্যায়ে খবর ছড়িয়ে পড়লে এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী জানান, কোহিনুর ও তার মেয়ে রোজিনার সামাজিক সম্মান নেই। রোজিনা দু’ স্বামীকে তালাক দিয়েছে। দ্বিতীয় স্বামী রমজান হাজীর কাছ থেকে চার লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এলাকার পরিবেশ নষ্ট হওয়ায় অনেকেই তাদের উপর ক্ষুব্ধ। নজরুলকে ডেকে নিয়ে আটক কওে আলকাতরা মাখানোর বিষয়টি তাকে জানানোর পর দফাদার আজিজুল ইসলামসহ দু’জনকে কোহিনুরের বাড়িতে পাঠানো হয়। সেখানে দফাদারকেও অপমান করা হয়। একপর্যায়ে স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের কয়েক’শ মানুষ কোহিনুর ও রোজিনার বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্টান ও পোল্ট্রি ফার্মে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। তেতুলিয়া হামিইউছুনুর কওমি মাদ্রাসা ও হাফিজাখানা পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মোস্তফা হাজী বলেন, তিনি বিষয়টি জেনেছেন। তবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটা আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার কাছে না জানিয়ে যেভাবে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে সেটা কোনমতে মেনে নেওয়া যায় না। আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কবীর বলেন, সামাজিক সম্মান নেই বলে কোহিনুর ও রাজিনার বাড়িতে যেভাবে ভাঙচুর ও মারপিট করা হয়েছে তা বেআইনি। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার কথা অস্বীকার না করেই তিনি বলেন, আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। লিখিত অভিযোগ পেলেই মামলা নিয়ে দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে। এলাকার শান্তিরক্ষায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।