রাজধানীর বনানীতে একটি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রায় দেড়মাস পর থানায় মামলা করেন ঘটনার শিকার এক শিক্ষার্থী।এরপর থেকে এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে তোলপাড়। পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে অস্বীকার করলেও শনিবার (৬ মে) বিকালে ধর্ষণের শিকার দুই শিক্ষার্থীর অভিযোগ মামলা আকারে নথিভুক্ত করে বনানী থানা। পার্টিতে ডেকে ধর্ষণ, তারপর দীর্ঘ নীরবতা এবং মামলা করার পর গত দুদিনেও অভিযুক্তদের আটক করতে না পারায় ফেসবুকে বইছে সমালোচনার ঝড়। ধর্ষণের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা, তা নিয়েও চলছে আলোচনা।
কেউ কেউ বলছেন, ২০১৬ সালে ভারতে তিন তরুণীর যৌন হয়রানির ঘটনাকে ঘিরে আইনি লড়াই নিয়ে তৈরি হওয়া বলিউডের আলোচিত চলচ্চিত্র ‘পিংক’ বাংলাদেশেও ঘটতে দেখা গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন তার পোস্টে লিখেছেন, ‘ আমি তো গয়না পরি না। পিকাসোতেও খাই না।আমি বিচার চাই। ধর্ষণ নির্যাতনের শাস্তি চাই। গ্লানি মোছে না। জরা ঘোচে না। বছরের বিচারহীনতার ওপর শুধু নতুন বিচারহীনতা পাঁজা হয়।’
প্রকাশক রবীন আহসানের মন্তব্য, ‘আমরা এদের পরিচয় জানতে চাই ! এরা কত বড় প্রভাবশালী ধর্ষক!বন্ধুরা ছবিটা ভাইরাল করুন। সব পাওয়া যাবে! এদের বন্ধু-বান্ধবরাই জানাবে! পুলিশের ভরসায় থাইকেন না…জনে জনে শেয়ার দিন।’
জেণ্ডার বিশ্লেষক ও লেখক চিররঞ্জন সরকার লিখেছেন, ‘সম্মতি। ধর্ষণের সংজ্ঞার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটা মানুষ সত্যিই ‘হ্যাঁ’ বলেছিল কিনা, দায়ে পড়ে/চাপে পড়ে/প্রতারিত হয়ে বলেছিল কিনা/খানিক দূর এগিয়ে পিছিয়ে আসতে চেয়েছিল কিনা/তার সম্মতি আংশিক ছিল কিনা/তার অসম্মতির ভাষা বুঝতে চাওয়া হয়েছিল কিনা, এসবই বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ধর্ষিতা নারী সন্তানসম্ভবা হলেও যেমন মনে করার কোনও কারণ নেই, যা ঘটেছে, তার সম্মতিতে ঘটেছে। কাউকে ভয় দেখিয়ে বা বেহুঁশ করে যদি তার সঙ্গে যৌন সংসর্গ স্থাপন করা হয়, তা কি ধর্ষণ নয়?’
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ লিখেছেন, ‘‘রেইনট্রির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মো. শরীফুল আজম এলাহী বলেন, ‘ঘটনার দিন সাফাতের জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে তারা পার্টির আয়োজন করে। ওইদিন সাফাত ও নাঈম দুটি কক্ষ বুক করে। কিন্তু সেখানে জোরপূর্বক কোনও কিছু ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এছাড়া তারা যে ফ্লোরে কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল, সেখানে আরও তিনটি কক্ষে অতিথি ছিলেন। সেখানে জোরপূর্বক কিছু হলে তারা তো আমাদের কিছু বলতো। তিনি আরও দাবি করেন, ঘটনার পরদিন সকালে দুই তরুণী হাসিমুখে বের হয়ে গেছেন। যদি জোর করে কিছু হতো তারা হাসিমুখে বের হতেন না (সূত্র পত্রিকা)।’ মনে হচ্ছে, পিংক সিনেমা দেখছি। হুবহু একই চরিত্রাবলী, একই দৃশ্যায়ন…’’
লেখক ও কলামিস্ট মাসুদা ভাট্টি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রভাবশালী ধর্ষকদের বাবারাও জানে যে, তাদের ছেলেরা যা কিছু করে মেয়েদের সম্মতি নিয়েই করে। প্রশ্ন জাগে, তারা কি এই সম্মতি আদায়ের সময় উপস্থিত থাকেন? না হলে জানলো কী করে যে, ছেলেরা মেয়েদের সম্মতি নিয়েই তাদেরকে ধর্ষণ করেছে?’
এই আলোচনায় বারবারই পিংক সিনেমাটির কথা উঠে আসছে। সিনেমায় নির্যাতনের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়ানো আইনজীবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বাংলাদেশের এই ঘটনায় কে নামবেন সেই ভূমিকায়, সে প্রশ্নও করেছেন অনেকে। সেখানে গণমাধ্যমই এই প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। সাংবাদিক শেরিফ আল সায়ার লিখেছেন, ‘PINK সিনেমাটা কতটা বাস্তব তা কি বুঝতে পারছেন?’
পলাশ আহসান তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখছি, ধর্ষকদের পক্ষে নেমেছে একটি দল। তাদের প্রধান যুক্তি, মেয়ে দু’টি পার্টিতে গেল কেন? … মেয়ে দু’টির পার্টিতে যাওয়াকে যারা দুষছেন তাদের বলি, পার্টি মানেতো একটা অনুষ্ঠান। ওই হোটেলে তো প্রায় প্রতিদিন পার্টি হয়। সব ধরনের ছেলেমেয়েরা যায়। ধর্ষণের অভিযোগ তো ওঠে না। সুযোগ পেলেই মেয়েদের ওপর ড্রাইভারসহ ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? … আমি জানি না, কী জবাব দেবেন ধর্ষক পক্ষ শিবিরের লোকজন।’
লেখক ও টেলিভিশন উপস্থাপক পারমিতা হিম স্যাটায়ার করে স্ট্যাটাটে লিখেছেন, ‘পার্টি করা তো আমাদের সংস্কৃতি নয়। সুতরাং কৃষ্টি-কালচারবিরোধী পার্টিতে কোনও ভালো মেয়ে যায় নাকি! কিন্তু ধর্ষণ করা তো আমাদের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য! ঐতিহ্যবাহী এ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে ধর্ষকদের পিঠ চাপড়াইয়া দেওয়া হোক।’ কোনও নারী হয়রানির শিকার হওয়ার পর এই প্রশ্নগুলো মানুষের মুখে মুখে ঘোরে বলেই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
ধর্ষণের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, গণমাধ্যম থেকে তাদের ছবিগুলো নিয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও করছেন অনেকে। তারা ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রতি সুবিচার দাবি করেছেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রীতি ওয়ারেসা তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘‘ভিডিও ছেড়ে দেবো’- এই বাক্যের দৈন্যতা মেয়েরা যতদিন না অতিক্রম করতে পারবে, ততদিন হাজার হাজার ধর্ষণ অপরাধের খবর মিডিয়ার সামনে আসবে না। ধর্ষণ ভয়ংকর একটা অপরাধ। এখানে ধর্ষিতা মেয়ে কোনোভাবেই অপরাধী নন। মেয়েদের শরীর সম্ভ্রম রক্ষার বস্তু নয় যে ভিডিওতে শরীর দেখা গেলেই সম্ভ্রমহানি ঘটবে! চারদিকে গেল গেল রব উঠবে!…ভিকটিমের প্রতি অনুরোধ, জোর গলায় বলুন- ছাড় ভিডিও। দেখুক পৃথিবী। যারা দেখবে শাস্তির ভার তারাই নির্ধারণ করবে…।’
ধর্ষণ মামলার তিন আসামির কোলাজ করা ছবি জুড়ে দিয়ে জেসমিন পাপড়ি নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ধরিয়ে দিন। মেয়ে দুটির প্রতি সুবিচার করুন।’
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী। গত শনিবার (৬মে) তারা বনানী থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ধর্ষণের ঘটনাটি ভিডিও করেছিল ধর্ষকরা। এই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখানো হয়। এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি হলেন- সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, শাদমান সাকিফ, ড্রাইভার বিল্লাল ও সাফাত আহমেদের বডিগার্ড (অজ্ঞাত)।