বহুজনের কাছে সিনেমা
দেখা ভালো কাজ নয়। সিনেমা নিয়ে আলাপ তাও ভালো বলে বিবেচনা করে না অনেকেই। আমরা খুব ভালোতে বিশ্বাসী। ভাবখানা এমন, মন্দে আমাদের মোটেও মন নেই। খুবই খাঁটিজন আমরা। আমরা মন্দ বলি না, করি না, ভাবিও না। এত ভালোগিরি দিয়ে লাভের খাতা কতটা ভারি হয়েছে আর লোকসানের পরিমাণ কত ভেবে দেখা হয় না। সিনেমা দেখা ভালো না, তাই ওদিকে মন নেই আমাদের। যাদের ওদিকটায় বেশি মনোযোগ তাদের প্রতি সমাজের বিশেষ মানুষেরা অশেষ মনোযোগহীন। মজার বিষয় হচ্ছে অনেক মনোযোগ না পাওয়া তরুণ চিত্রনির্মাতাদের চিন্তা ভাবনা, কুশলতা বিদেশের মাটিতে বিশেষ মনোযোগ কুড়াতে পারছে। সেদিন বিবিসির এক রিপোর্টে দেখলাম, শুনলাম ভারতে নির্মিত বাহুবলী সিনেমার ধাক্কায় বিশ্ববাসী একযোগে ভারতীয় সিনেমার দিকে চোখ বড় করে তাকাতে বাধ্য হয়েছে। ভারতের বাইরে ভারতীয় সিনেমার বাজার অনেকদিন ধরে একটু একটু করে অনেকটা জমেছিল। এক বাহুবলী হঠাৎ সে পরিমাণটাকে চুরমার করে দিয়ে সিংহভাগ আয়ত্বে নিতে পেরেছে। সিনেমা একটা দেশকে মাথায় তুলে কোন উচ্চতায় স্থাপন করতে পারলো, পারে ভাববার সামর্থ্য থাকলে সিনেমা বানানো, দেখা, আলাপ, প্রশংসা মন্দ কাজ বলে বিবেচনা করাদের মতির গতি পাল্টাবে।
বাহু নয় চিন্তার বল দেখার আগ্রহ ছিল মনে। দেখে আসা হলো বাহুবলী। এই দেখে আসার ধরন খুবই বিশেষ। ছত্রিশজন একসাথে ঢাকা থেকে কলকাতা উড়ে গিয়ে সিনেমা দেখা বিশেষই তো। আমাদের জীবনে এমন ঘটনা না ভোলার মতো, অত্যন্ত আনন্দের হয়ে থাকবে। বিষয়টা নিয়ে ভালো কথা, মন্দ কথা হতে পারে, ঠাট্টা মস্করা হতেও পারে। ভ্রু কোঁচকানো আলাপ সালাপ, তাও হয়তো হবে। নিজের রুচি অভিরুচি অনুযায়ী যে যেমন মন্তব্যই করুক, আমাদের মন্তব্য হচ্ছে সামর্থ থাকলেই মানুষ অনেক কিছু করে না বা করে উঠতে পারে না। আনন্দময় মনে হলেও সে আনন্দ অর্জনের তাগিদ বহু মনে থাকে না। সব মনে কৌতুহল থাকে, সে কৌতুহল টান মেরে এতজনকে একসাথে এমন আনন্দে সামিল করায় না। মানুষের মনে ইচ্ছা জাগবে, সে ইচ্ছা পূরণের ইচ্ছা সকল মনে বিশেষভাবে জেগে ওঠে না বলে ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে যায়।
আমরা যেদিন বাহুবলী দেখতে গেলাম, হলে ঢোকার আগে দেখতে পাই শুধু আমরা নই তখন কলকাতায় থাকা অনেক বাংলাদেশি-ই আনন্দ উত্তেজনা নিয়ে সেখানে অপেক্ষমান। কারও কারও সাথে পরিচয় ঘটেছে। আমরা এতজন একসাথে সিনেমা দেখতে এসেছি শুনে তারাও অবাক না হয়ে পারেনি। অবাক করলেও ঘটনা কি অতটা অবাক করানোর মতো? পরিচয় হওয়া পাঁচজনের একটা পরিবার সে রাতে বাহুবলী দেখতে গিয়েছে। পরিচয়ের পর জানা হলো, কলকাতায় আসবার পরিকল্পনা আগেই ছিল, ছেলে মেয়েদের আগ্রহে বাহুবলীর মুক্তির সাথে আসা ও থাকার দিন মেলানো হয়েছে। সে মতই রথ দেখা ও কলা বেচা একসাথে হয়ে যাচ্ছে। ছত্রিশজন তাহলে অনেক নয়। আমরা গিয়েছি অনেকগুলো পরিবার একসাথে, কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু একত্রে। আলাদা আলাদাভাবে সবারই কলকাতা এসে রথ দেখা ও কলা বেচা হয়, হয়েছে বহুবার। এবারই প্রথম সবাই মিলে আসা হয়েছে শুধুই রথ দেখতে।
বাহুবলী তো রথ দেখার মতই। কলকাতায় অনেককে বলতে শুনেছি, কোথাও কোথাও পড়েছিও, ছবিটা নিয়ে মানুষের বাড়াবাড়ি একটু বেশি রকমের। হলেও সেটা দোষের নয়। মুক্তির আগেই যদি ছবিটা জনমনে অতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরে থাকে, তা তো ছবিটা এবং তার পেছনের মানুষদের কৃতিত্বই। জেনেছি, বাহুবলী একসাথে নয় হাজার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা দেখবার জন্য রেকর্ড সংখ্যক মানুষ অগ্রিম টিকেট কেটেছে। ব্যবসা বিষয়ক একটা পত্রিকা লিখেছে, আমেরিকাতে এই প্রথম একটা ভারতীয় ছবি একসাথে এক হাজার চারশত প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে। আরো জানতে পারি, তেলেগু, তামিল, হিন্দি, ইংরেজি- বহু ভাষায় বাহুবলী মুক্তি পেয়েছে। ২০০ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত বাহুবলী ভারতের বাইরে সারা বিশ্বের এগারো শত সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে এবং আগ্রহ সৃষ্টি করার মতো ঘটনার পর ঘটনার জন্ম দিয়েই চলেছে। দু’একটা খবর কানে পৌঁছালে বাহুবলী বিষয়ে কৌতুহল জাগবারই কথা। যত কথাই হোক সামগ্রিকভাবে এ হুলস্থুল ছবি অতি আগ্রহ তৈরির উপাদানে ভরপুর। তাই সে চলচ্চিত্র দেখার জন্য জগতজুড়ে এত হুড়োহুড়ি।
অনেকে বলতে পারেন বাহুবলী এত মাতামাতি করার মতো ছবি নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মাতামাতি হচ্ছে। বাহুবলীর দ্বিতীয় পর্ব দেখে অনেক দর্শক প্রথম বাহুবলীর মতো আনন্দ পায়নি বলেছে। মতামত এক একজনের এক এক রকম হতেই পারে। মানুষ মানেই মত। মানুষের মনে যে বিষয় বিশেষ গুরুত্ব তৈরি করতে পারে মানুষ মতামত প্রকাশ করে সে বিষয়েই। সে যুক্তিতে বাহুবলী নিয়ে বিশেষ বলাবলি চলছে, চলতে থাকবে অনেকদিন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা দিয়েছে এ সিনেমা এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করবে। ভারতের সিনেমা বাণিজ্য আরও উঁচু লক্ষ্যে পৌঁছে গেলো।
শুরুতে যা লিখেছি, বাহু নয় চিন্তার বল দেখার আগ্রহ ছিল মনে। ছবিটা নিয়ে মন্দ বলে আনন্দ পেতে হবে কেন? বিশেষ ছবি ভেবে ভালোলাগার মতো বিষয়গুলোকে তো বড় করে দেখা যায়। যে ছবি সাধারণ নয়, যে ছবি নিয়ে অসংখ্য মানুষ স্বপ্ন বুনেছে, স্বপ্নের মতো রূপ দিতে চেয়েছে, তা বড় মাপের হলে কতটাই বা অসুন্দর হতে পারে। মুহূর্তে মুহূর্ত বিস্ময় সৃষ্টির চেষ্টা আমরা সমীহ করেছি। দোষ ত্রুটি থাকুক, তা আমাদের হয়রান করেনি। ছবি দেখে ঠকে গেলাম না জিতে গেলাম এসব নিয়ে মাথা ঘামানো অবান্তর। অবাক হয়েছে সবাই। সবারই মনে হয়েছে, মানুষের সাধ্য রয়েছে, সামর্থ সীমাহীন, শুধু সাধ থাকলেই হয়।
অনেক মানুষের সাধ্য রয়েছে। চেনা জানা অনেক মানুষের সামর্থ্য সীমাহীন, সাধও রয়েছে এক একজনের এক এক রকম। বাহুবলী কেউ বানাবে, এমন ছবি বানাতে চাইবে, যে ছবি দেখার জন্য সারা বিশ্বে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। হুড়োহুড়ি ফেলে দেওয়ার সাধে অন্যায় নেই। যারা এত আগ্রহে ছবিটা দেখার জন্য ছুটবে না, ছোটেনি তারাও দোষ করেনি। জগতে যা ঘটবার ঘটে চলবে। মানুষের ভাবনাও, যার যার মতো চলতে থাকবে।
‘কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেন মারলো’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষ হুড়মুড়িয়ে ছুটছে সিনেমা হলের দিকে। সে ছোটা থামছে না। তা নিয়ে লেখালিখি হচ্ছে বিস্তর এবং বিচিত্র রকম। অধিকাংশকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেওয়ার মতো কাণ্ড বাহুবলী ঘটাতে পেরেছে। জানা গেলো ভারতের কোনও প্রদেশে নিয়মিত চারটির বদলে আটটি প্রদর্শনীর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট দৈর্ঘ্যের বাহুবলীর নির্মাতা এস এস রাজামৌলি। যে যত কথাই বলুক, রাজামৌলি সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা সহজে দেখতে পারেন। সেই স্বপ্ন দেখাতে সবাইকে জড়ো করতেও পারবেন। এমন আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই প্রবল বাহুবলী জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হয়ে চলেছে।
আমরাও সে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি, বলতে দ্বিধা নেই। দলে বলে ঢাকা থেকে কলকাতায় উড়ে গেছি বাহুবলী দেখতে। আসলে দেখতে গেছি চিন্তার বল। আমাদের বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগর, সাগর বাহুবলী জ্বর এবং বাহুবলী স্বপ্ন উভয়েই আক্রান্ত। প্রথম বাহুবলী দেখার পর থেকে সে ছবির বিস্ময়কর জায়গাগুলো যখনই সময় পায়, দেখেছে আর ভেবেছে- এরকম একটা স্বপ্ন তো আমরাও দেখতে পারি। দ্বিতীয় পর্ব যখন আসি আসি করছে, পরিবার বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে সে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা এঁটেছে মনে মনে। সাগর ভেবেছে ভালোলাগার ছবিটা একসাথে সবাই মিলে দেখা হবে মহাআনন্দের। ভেবেছে, ঢাকায় সবারই খুব ব্যস্ত জীবন, অবসর মেলেনা কারোরই। একসাথে একটা দিন অভিনব উপায়ে কাটানোর উপলক্ষ্য হবে বাহুবলী। হয়েছেও তাই। অনেকটা বয়স অতিক্রম করে এসে, যখন এদিক সেদিকে দেখি, মানুষে মানুষে সম্পর্ক এখন স্বার্থ ও সুবিধার অংকে ভরপুর। প্রায় সবাই এখন সম্পর্কের অন্দরে আবেগের জায়গা কমিয়ে হিসাব নিকাশের জায়গা বাড়িয়ে তোলায় ব্যস্ত। সংবেদনশীলতা কমিয়ে হৃদয়ে পোক্তভাবে ভান ভনিতার বাড়ি তৈরির জন্য সাগ্রহে জায়গা ছাড়তে প্রস্তুত। এরকম সময়ে দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়ার মতো ছেলেমানুষি আনন্দের সাধ পঞ্চাশোর্ধ বয়সে জাগে, তা পরম সৌভাগ্যের।
বাহুবলীর ভিডিও ঢাকায় এলে অনেকের মুখে ছবিটার কথা শুনেছিলাম, দেখা হয়ে ওঠেনি। পত্রিকায়, এখানে ওখানে বাহুবলীর পোশাক আষাক দেখে অনুমান করে নিয়েছি রাজারাজড়ার গল্প, দেখার আগ্রহ জাগেনি। বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগর একদিন অতি আনন্দে, উত্তেজনায় জিজ্ঞাসা করে বাহুবলি দেখেছি কিনা। উত্তরে সে না আশা করেনি। তুমুল উৎসাহে নিজের ফোনে ধরে রাখা বাহুবলীর একটা গান দেখায়। অসামান্য প্রকৃতি, অবিশ্রাম ঝর্না জলরাশি, মোহিত হওয়ার মতো চিন্তা শক্তি, মুগ্ধ হওয়ার মতো চিত্রায়ন তার মধ্যে নায়ক নায়িকার অভিনয় দেখে বাক্যহারা হতেই হয়। পুরো ছবিটা না দেখে থাকা যায় না।
বন্ধু বান্ধব পরিচিতজন যার সাথেই তারপর থেকে দেখা হয় সবার কাছেই সাগরের সেই গান দেখানোর গল্প শুনি। চল্লিশ বছর ধরে সাগরকে জানি, আমাদের আর ওর আনন্দ, উত্তেজনার প্রকাশ এক নয়। বাহুবলী বা ওই গান কাছেরজনদের দেখানোয় তার আনন্দ বা ছবি বিষয়ে আলাপের আগ্রহে নয়, এমন সিনেমা বা গানের কল্পনা মানুষ করতে পারে এবং তার বাস্তবায়ন সম্ভব ভেবেই সাগরের আনন্দ। এমন মাপের সিনেমা পৃথিবীতে আগে সম্ভব হয়েছে। পাশের দেশ ভারতে সম্ভব হলো। আগামীতে এমন স্বপ্ন আমরাও দেখতে পারি। পারা না পারার কথা পরে, আগে তো মানুষকে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন দেখতে জানলে স্বপ্নপূরণ মানুষের অসাধ্য নয়।
যুবকবেলায় পাঁচ সাতজন একত্রে ছবি দেখা হয়েছে বহুবার। এইবেলায় এসে বড় ছোট মাঝারি মিলে ছত্রিশজন একসাথে সিনেমা উপভোগ অবিস্মরণীয় ঘটনাই। একটা উপলক্ষে, একত্রে অনেকটা সময় নবআনন্দে কাটানো হয়েছে, নির্ভেজাল আড্ডায় ওঠে এসেছে স্বপ্ন ও সার্থকতার কথা। বাহুবলী শুধু সিনেমা দেখা নয়, মনে করিয়ে দিয়েছে বেঁচে থাকা বড় কথা নয় বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হয়। বড় স্বপ্ন মানে বড় করে বেঁচে থাকা। বড় স্বপ্ন মানে জীবনে নতুন সম্ভাবনা, অনুপ্রেরণা। রোজ ক্ষুদ্র চর্চায় যে আনন্দলাভ হয় তা আসলে সত্য নয়, ঘোর। এই ঘোরের চক্কর থেকে বের না হতে পারলে অর্থবহ জীবনলাভ হয় না, হবে না। আমাদের এত রূপকথার গল্প, সব পড়ে আছে অন্ধকারে। বাহুবলী সাগরের মধ্যে একটা স্বপ্ন তৈরি করে দিয়েছে। এমন ধরনের সিনেমা তো আমাদের দেশেও হতে পারে। যারা সাগরকে চেনে, সবারই জানা দেশের জন্য প্রথম এবং নতুন কিছু করার ইচ্ছা তার মনে যদি জাগে সে ইচ্ছা সাগর অপূর্ণ রাখে না। বাহুবলী স্বপ্নে আমাদের যদি জাগরণ ঘটে, তা সমগ্র জাতির ধ্যান ধারণা ও সংস্কৃতিকে পাল্টে দিতে পারে। সিনেমাকে আমরা ভালো চোখে দেখতে শিখিনি, সে দোষ সিনেমার নয়। আমাদের অসচেতনতা, ব্যর্থতা। আমরা গায়ের বল, বাহুর বল, গলার বল নিত্য হজম করে চলেছি। বাহুবলী চিন্তার বল, অসাধারণ। মনের বল, চিন্তার বলে বলীয়ান হতে পারলে বাহুবলী এ ভূমিতেও ঘটতে পারে। স্থির বিশ্বাস, ঘটবেও।
লেখক: অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রশিল্পী