দুর্নীতি প্রতিরোধ স্বচ্ছতা, জবাদিহতিা এবং কার্যকর প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবাধ তথ্য প্রবাহ, তথ্যে জনমালিকানা এবং তথ্য প্রদানের সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। জনগণের জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে পুরো জাতি অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বিহীন সেবা ব্যবস্থা এমনকি দুর্নীতির মতো অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। তথ্যের প্রয়োজনীয়তা, তথ্যের অভাবে কি সমস্যা হয়, তথ্যের সাথে জনগণের ক্ষমতায়নের সম্পর্ক, নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে কী কী সেবা পাবার অধিকারী, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, সেবা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানলে একদিকে নাগরিকরা যেমন ক্ষমতায়িত হবে অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং জবাদিহিতার চর্চা হবে। যদি শুধুমাত্র তথ্যের উৎস সম্পর্কে জনগণ জানতে পারে, তাহলে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বোঝা থেকে অনেকাংশে জাতি মুক্তি পেতে পারে। যদি যথাসময়ে, যথাস্থানে, যথাযথ তথ্যের আয়োজন নিশ্চিত করা যায়। ফলশ্রুতিতে জনগণ তথ্য জানবে, ক্ষমতায়ীত হবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। যার কাছে যতোবেশি তথ্য আছে সে ততোবেশি শক্তিশালী। অবাধ তথ্য মানুষের সামনে অসংখ্য বিকল্প উপস্থাপন করে। তার করণীয় নির্ধারণে, সমস্যা মোকাবেলায় অসংখ্য বিকল্প তার সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা এনে দেয়। যা তাকে ক্ষমতায়িত করে। এই তথ্যে মালিকানা অর্জন বা নিশ্চিত করা, তথ্য প্রদানের সদিচ্ছা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অনিবার্যতা দাবী করে। সে উপলব্ধি এবং প্রয়েজনীযতা থেকে সরকার ২০০৯ সালে ” তথ্য অধিকার আইন ২০০৯” যুগান্তকারী আইন সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় হুইসেল ব্লোয়ার প্রেটেকশন এক্ট-২০১২ পাশ হবার ফলে তথ্যপ্রদানে আগ্রহী কর্মকর্তগণ নির্ভয়ে তথ্য প্রদান করতে পারবে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর মাধ্যমে জনগণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ ও দায়িত্ব-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জেনে, তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে পারে। এত বড় ক্ষমতা দেশের অন্য কোনো আইন জনগণকে দেয়নি। তাই এই ক্ষমতা কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা সবাইকে ঠিকমত বোঝা প্রয়োজন। এতেকরে আইনটির ব্যবহার বাড়বে, গণতন্ত্রের প্রসার হবে এবং দেশ ও দশের উপকার হবে এবং রাষ্ট্র সুরক্ষিতহবে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রজত-জয়ন্তী পালনের লক্ষ্যে “রূপকল্প ২০২১” নামে সরকার যে কর্মসূচী গ্রহণ করেছে ও তার সঙ্গে “জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল” নামে যে সব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে তথ্য অধিকার আইনটি কার্যকর করার বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে ফলে আইনটিকে কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার অন্তত কাগজে কলমে বেশ তৎপর। আইনটিকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে সেই সব লক্ষ্য পূরণ হবে না। সরকার আইনটির প্রয়োগের জন্যে দেশের প্রতিটি জেলায় ১৬ জন সরকারী-বেসরকারী ব্যক্তিকে নিয়ে একটি জেলা পরামর্শক কমিটি বা ”ড্যাক” গঠন করেছে যার দায়িত্ব আইনটির বাস্তবায়নের জন্যে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে এখন পর্যন্ত বছরে ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার দিবস পালন, কখনো কখনো ড্যাক এর সভা আর সামান্য ক্যাম্পেইন আর বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসে তথ্য কর্মকর্তার নামফলক টাঙানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তথ্য কমিশনের বাৎসরিক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, আইন প্রনয়নের পর প্রথম কিছু বছর আবেদনের সংখ্যা উর্দ্ধগামী হলেও বিগত কয়েক বছর তা নি¤œগামী। হয় নাগরিকরা তথ্য জানতে আগ্রহী নয় নতুবা তথ্যপ্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অফিসের অনীহা কিংবা গোপনীয়তার হ্যাংওভার থেকে এখনো তারা বের হতে পারেনি। যেন এখনো মনে পুরানো ভয় “ জনগণ যতো জানবে, ততো কম মানবে”।
তথ্যের ওপর গোষ্ঠীবিশেষের মালিকানার অবসান ঘটানো এবং সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন। কারণ, এই সমস্যার মূল অনেক গভীরে। বৃটিশরা তাদের শোষণ বজায় রাখার জন্য ১৯২৩ সালে প্রণয়ন করে অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট। বৃটিশরা বিদায় নিয়েছে বহুকাল কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া গোপনীয়তার সংস্কৃতি আজো বিদ্যমান। যে কারণে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে তথ্য অধিকার আইন পাশ হলেও গোপনীয়তার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি দেশের অধিকাংশ সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হালের ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট- ২০১৮। এখনো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়নি, অনেক অফিসে তথ্য কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হলেও তা নিতান্তই দায়সারা গোছের/প্রকৃতির। আবার অনেকে তথ্য অধিকারের সাথে আইসিটি অ্যাক্টকে এক করে ফেলেন। তথ্য প্রদানের জন্য যে ধরনের প্রস্ততি বা তথ্য ভা-ার গড়ে তোলা দরকার সেটিও লক্ষনীয় নয়। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়রানীও লক্ষ করা যায। বিশেষ গোষ্ঠী যেন সকল তথ্যের মালিক এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে এটাই যেন বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য অধিকার আইনকে জনগণের বিশেষ করে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আইনে পরিণত করার জন্য তথ্য কমিশন এবং টিআইবিসহ বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেলেও জনগণের মধ্যে তথ্যের চাহিদা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা অপ্রতুল। জনগনের মধ্যে তথ্যেও চাহিদা সৃষ্টি এবং জনগণকে পুরোপুরি সচেতন করা না গেলে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার অন্যান্য অনেক অধিকারের মত অধরাই থেকে যাবে। দেশের অধিকাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথ্য প্রাপ্তির জন্য লিখিত আবেদন করবে সেটা কতখানি যৌক্তিক তা ভেবে দেখার বিষয়। তারপর আপীল এবং তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের সেতো সুদূর পরাহত। তথ্য প্রাপ্তির প্রক্রিয়াটি এমন যে, জনগণের যে অংশটি বেশী বঞ্চনা-দুর্নীতির শিকার তথ্যে সে অংশটির অভিগম্যতার সুযোগ ততোটাই কম। দেশের কত শতাংশ মানুষ তথ্য প্রাপ্তির ফরম সম্পর্কে জানে? কত শতাংশ মানুষ সংশ্লিষ্ট ফরমগুলো যথাযথভাবে পূরণ করতে জানে? আর কতগুলো অফিসে তথ্য প্রাপ্তির আবেদন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক সাদরে গৃহীত হয়? সনাকের একজন উজ্জীবিত ইয়েস সদস্য (কলেজ পড়ুয়া) পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে একটি তথ্য প্রাপ্তির আবেদন করলে তার খেসারত হিসেবে তার পিতাকে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এল আর ফা-ের তথ্য জানতে চাইলে বলেন ক্যাবিনেটের অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়। এই যদি হয় জেলা পর্যায়ে সরকারের আইন বাস্তবায়নকারী সর্বোচ্চ কর্মকর্তার তথ্য প্রদানের মনোভাব এবং একজন শিক্ষিত সচেতন ছাত্রের তথ্য আবেদনের অভিজ্ঞতা তাহলে গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া, নিরক্ষর মানুষের পক্ষে তথ্য প্রাপ্তির আবেদন কতখানি ফলপ্রসু হবে তা ভেবে দেখার বিষয় বটে। ভারতবর্ষে তখন বর্ণাশ্রম প্রথার রমরমা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিনে মিলে শুদ্রদের ‘বেদ’ (তখন সেটিই একমাত্র তথ্য) এর অধিকার কেড়ে নিয়ে এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে, তাদের দাসে পরিণত করে যখন সকল সম্পদ ও ক্ষমতার ওপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কায়েম করেছে- এমনই এক সময়ে এক ব্যাধের সন্তান, শুদ্র যুবক একলব্য এসেছিল সে যুগের শ্রেষ্ঠ সমরবিদ দ্রোণাচার্যের কাছে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্যে। একলব্য সেখানে দ্রোণাচার্যের কাছে ‘তথ্য’ কিন্তু ঠিকই পেয়েছিল, তা হলো- “এ বিদ্যায় নাহি তব অধিকার।” এটা তো নিঃসন্দেহে একটি তথ্যই। কিন্তু এরকম তথ্য পেয়ে ফিরে আসার মধ্যেই নিশ্চয়ই তথ্যে জনমালিকানার সার্থকতা নিহিত নেই। তথ্য যদি শুধু অধিকারহীনতার তথ্যই দেয় তবে সে ‘মালিকানার বোঝা’ বয়ে বেড়াবার সাধ জনগণের থাকার কথা নয়। তাই কেবল মাত্র আইন প্রযোগ করেই তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হবেনা। তথ্য যে একটি সেবা, জনগণের এগিয়ে যাবার উপায়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা চর্চার অন্যতম হাতিয়ার সেটি সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে এবং সে অনুযায়ী তথ্য সম্ভার আয়োজন, বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রচারের পাশাপাশি অনেক বেশী প্রয়োজন সেটি হলো জনশুনানীর মতো অনুষ্ঠান আয়োজন, যেখান থেকে জনগণের চাহিদা জানা যাবে এবং সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হবে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ লেখক: রাজেশ অধিকারী, উন্নয়ন কর্মী