দেবহাটা

দেবহাটা উপজেলা ভূমি অফিসে বেড়েছে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য।

By daily satkhira

October 05, 2020

দেবহাটা ব্যুরো : দেবহাটা উপজেলা ভূমি (এসিল্যান্ড) অফিসে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। দালালদের হাতে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে উপজেলা ভূমি অফিসটি। নির্ধারিত সময় পর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বদলি হয়ে অন্যত্র গেলেও মুলত এই ভুমি অফিসের দালালরা রয়ে যায় বহাল তবিয়তে। কোনো কোনো কর্মকর্তা দালালদের উৎখাতের বিষয়ে প্রথম দিকে লম্ফঝম্ফ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই অদৃশ্য কারণে সব থেমে যায়। উপজেলা ভূমি অফিসের এমন কোনো কাজ নেই যা দালালদের জন্য সম্ভব নয়। দালাল না ধরে সরাসরি অফিসে গেলে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। এ কারণে কাজ উদ্ধারের স্বার্থে সাধারণ মানুষ দালালদের হাত ধরে উপজেলা ভূমি অফিসে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর মাধ্যমেই দেবহাটা উপজেলা ভূমি অফিসে ধীরে ধীরে ডালপালা বাড়ছে দালালদের। দেবহাটা উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধূ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে উপজেলা ভূমি অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেবহাটা উপজেলা ভূমি অফিসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। সকাল থেকেই এসব দালালরা ভুমি অফিসের পাশে ছফেদা তলার চায়ের দোকানে ওৎ পেতে বসে পড়ে। তারপর ফাইলপত্র নিয়ে ভুমি অফিসের দিকে কাউকে আসতে দেখলেই বুঝে ফেলেন বেচারা জমিজমা নিয়ে ঝামেলায় রয়েছে। সাথে সাথেই গল্পের ছলে সেসব ব্যাক্তিদের কথার জালে আটকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেন দালালরা। এসব দালালদের মধ্যে নেপথ্যে রয়েছে উপজেলার তিলকুড়া গ্রামের আমিনুর রহমান, দেবহাটা সদর ইউনিয়ন ভুমি অফিসের বহুল আলোচিত অফিস সহকারী মিজান, বসন্তপুর গ্রামের আবুল কালাম, একই গ্রামের আনিস, কামটা গ্রামের আব্দুল মান্নান, কোড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ ও হাদিপুরের নজরুল ইসলাম। এছাড়াও এই দালাল চক্রে রয়েছে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ভুমি অফিসে কর্মরত কতিপয় দূর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সখিপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির কিছু দলিল লেখক ও তাদের সহকারী (মুহুরী) মিলিয়ে আরো ২০/২৫ জন দালাল। দালালদের অধিকাংশেরই এখন উপজেলা ভূমি অফিসে অবাধ বিচরণ। এমনকি তাদের অনেকেই ভুমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়ারে বসে অথবা ভুমি অফিসের সামনে থাকা গণশুনানীর ঘরটিতে প্রতিনিয়ত খদ্দের নিয়ে কাগজপত্র মেলিয়ে অস্থায়ী অফিস খুলে বসে কাজ করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে জমি মিউটেশনের কথা বলে এসব দালালরা প্রথমে সেবা প্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। তারপর টাকা নেয়া শেষ হলেই সেবাপ্রার্থীদের সাথে করতে থাকেন তালবাহানা। বছর ঘুরে নতুন বছর এলেও দালালদের থেকে কাঙ্খিত মিউটেশনের কাগজ বুঝে পাননা সেবাপ্রার্থীরা। সরকারীভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ১১৫০ টাকা ফি নির্ধারিত থাকলেও, সেবাপ্রার্থীদের জিম্মি করে এসব দালালরা জমি মিউটেশনের জন্য ব্যাক্তি বিশেষে হাতিয়ে নিচ্ছে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। গেল বছরের ১৮ আগষ্ট জমির মিউটেশনের জন্য দালাল আমিনুরের সাথে ৭ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তি হয় পারুলিয়ার নাজিরের ঘের এলাকার মৃত মাদার গাজীর ছেলে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল্যাহ গাজীর এবং একদিন পর ১৯ আগষ্ট ওই আমিনুরের সাথে মিউটেশনের জন্য ৫ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তি হয় সখিপুরের ধোপাডাঙ্গা গ্রামের মৃত রজব আলী সরদারের ছেলে ৬১ বছরের বৃদ্ধ আবু তালেবের। চুক্তি পরবর্তী আব্দুল্যাহ গাজীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ও আবু তালেবের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় আমিনুর। এরপর থেকে চলছে আমিনুরের তালবাহানা। প্রায় ১৩ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও কাঙ্খিত মিউটেশনের কাগজ হাতে না পেয়ে প্রায়ই উপজেলা ভুমি অফিসে ধর্না দিচ্ছেন দুই বৃদ্ধ আব্দুল্যাহ গাজী ও আবু তালেব। তবে বহিরাগত দালালদের চেয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে সবচেয়ে পটু সদর ইউনিয়ন ভুমি অফিসের বহুল আলোচিত ও সুচতুর অফিস সহকারী মিজানুর রহমান মিজান। জমিজমা সংক্রান্ত এমন কোন কাজ নেই, যেটা মিজানের কাছে অসম্ভব। তাকে টাকা দিলে দাপ্তরিক যেকোন কাগজ আনঅফিসিয়ালি পৌছে যায় যেকোন মানুষের হাতে। এমনকি টাকার বিনিময়ে একজনের জমি অন্যের বানিয়ে দিতেও এক্সপার্ট মিজান। একবছর আগে জমির মিউটেশন করিয়ে দেয়ার কথা বলে মিজান উত্তর সখিপুর গ্রামের মৃত মাদার মন্ডলের ছেলে জেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির প্রচার সম্পাদক পরিতোষ মন্ডলের কাছ থেকে প্রায় ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। কিন্তু বছর গড়িয়ে আসা বছরটি শেষ হতে গেলেও অদ্যবধি মিউটেশন না করে বরং তালবাহানা ও বিভিন্ন অজুহাতে পরিতোষ মন্ডলকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন মিজান। বর্তমানে এমন বহু মিজানের জন্ম হয়েছে উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়ন ভুমি অফিস গুলোতেও। ভূমি অফিসের সব ধরনের কাজ নিজ হাতে করতে এসব দালালদের কোনো বাঁধা নেই। এ কারণে সাধারণ মানুষ উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে অফিসার ও দালালদের আলাদা করতে না পেরে প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি ভূমি অফিসের অনেক কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কাছে সেবাপ্রত্যাশী মানুষ সহযোগিতা চাইলে চুক্তিবদ্ধ দালালদের কাছে পাঠিয়ে দেন তারা। দালালদের সঙ্গে চুক্তি না করে সাধারণ মানুষের ভূমি অফিসের সেবা পাওয়া দুষ্কর। জমির মিউটেশন থেকে শুরু করে জমির খাজনা পরিশোধ, মিসকেস, খাস পুকুর ইজারা, বিভিন্ন অভিযোগের হিয়ারিং এবং তদন্তের রিপোর্ট পক্ষে-বিপক্ষে দেয়া ইত্যাদি বিষয় অনায়েসে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব দালালদের জুড়ি নেই। উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কতিপয় দূর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই স্টেশনে কর্মরত আছেন। বছরের পর বছর ধরে একই ষ্টেশনে কাজের নজির রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন একই এলাকায় অবস্থানের কারণে স্থানীয় দালালদের সঙ্গে তাদের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করছেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দালালরা লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে টাকার পাহাড় গড়ছেন ভূমি সংশ্লিষ্টরা। তাদের আস্কারা পেয়েই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে দালালরা। যদিও ভুমি অফিসে ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়ে সবারই জানা তারপরও কোনো তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় না সে প্রশ্ন এখন উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের। এদিকে প্রশাসনের নাকের ডগায় দালাল চক্রের এমন দৌরাত্ম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাজিয়া আফরীন বলেন, প্রায় ১৯ বছর দেবহাটা উপজেলা ভুমি অফিসে কোনো সহকারী ভুমি কমিশনারের (এসিল্যান্ড) পদায়ন না থাকায় হয়তো দালালরা মানুষকে প্রতারিত করার সুযোগ পেয়েছে। যদিও সম্প্রতি একজন এসিল্যান্ডকে পদায়ন করা হয়েছিলো কিন্তু ইতোমধ্যেই তার অন্যত্র বদলী হয়ে গেছে। তাছাড়া দালালদের ব্যাপারে এরআগে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে তদন্ত করে দালালদের উৎখাতের ব্যবস্থাসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান ইউএনও।