সাতক্ষীরা

অদম্য শেখ হাসিনা : প্রস্ফুটিত নেতৃত্বের গুচ্ছগাথা

By daily satkhira

October 08, 2020

কন্যা ফেরে ঘরে। নাওরি হয়ে বাপের বাড়ি ফেরা আনন্দে ডগমগ বাড়ির চঞ্চল মেয়েটির কথাই সবার আগে চোখে আসে। চিত্রপটে কুলায় ধান-দুর্বা আর ফুলের সাজিতে বরণঢালা সুশোভিত পৈঠা। শ্যামল বাংলার এক কন্যা ফিরেছিল ঘরে ১৯৮১ সালের এক বর্ষণমুখর দিনে। তার জন্য মা-বাবা কিংবা ভাই-ভাবিরা কুলায় ধান-দুর্বা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল না। বরং ঘাতকচক্রের নৃশংসতায় স্বজনদের করুণ পরিণতির শঙ্কা তার মনে ঘাই দিয়ে গেছে নিরন্তর। নিতান্ত এতিম এক তরুণী অদৃশ্য আততায়ীর বন্দুকের নলের ছায়ায় পা রাখে মাতৃভূমিতে। দীর্ঘ নির্বাসন-ফেরা এই কন্যার মনে তখন স্বজনমিলনের বদলে জনগণমনের বৃহত্তর স্বপ্ন। ‘বৃৃষ্টি সেদিন সতেরোই মে, কন্যা ফেরে ঘর। আকাশ নয় বাতাস নয়- কাঁদে পঁচাত্তর। নৌকা বলে চোখের পানি এতদিনে মুছবে জানি। লক্ষ মানুষ ভেজে মানুষ, সড়কে আজ বন্যা- বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরে বঙ্গবন্ধু-কন্যা।’ ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ বইয়ের শুরুটা এমনই। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের এই কাব্যের শেষটা- ‘কন্যা তো নয়, কন্যা সেই স্বপ্নের পরম্পরা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে স্বপ্নের সোনার বাংলার বাতি নিভেছিল, তারই সলতে যেন তার কন্যার ফেরার মধ্য দিয়ে উসকে উঠল।

পাঠক, সূচনা থেকে মনে করবেন না এটা কোনো কবিতার সংকলন। মূলত দুটি অনবদ্য কবিতা দিয়ে বইয়ের মুখটা নিকোনো। সম্পাদনার মুনশিয়ানা বুঝি। ভেতরে নানা স্বাদ আর আঙ্গিকে প্রবন্ধের সচিত্র ডালি সাজানো। পাঠের পাশে খানিক দর্শনের অবসর।

১৯৮১ থেকে চলমান ২০২০। এতিম তরুণী থেকে বিশে^র প্রভাবশালী সরকারপ্রধান। এই রূপান্তরের মাঝে কত না ঘটনা বয়ে গেছে হাওয়ায় হাওয়ায়। তাতে কত রূপে, কত ভূমিকায় অংশী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। আর্জন আর সাফল্যের নানা অভিধার উত্তরীয় জড়িয়েছে তাকে সময় সময়। গত ৩৯ বছর ধরে অদম্য এক নেতাকে দেখছে বাংলাদেশ; দেখছে বিশ^ও। শোক, ষড়যন্ত্র, আঘাত, ঘাতকের বোমা, গুলি- সব পায়ে দলে এগিয়ে গেছেন তিনি। ‘সাহসিকতা এবং ঝুঁকি এই দুই-ই জীবনের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিকল্পহীন শর্ত। প্রকৃতপক্ষে, জীবনে ঝুঁকি নিতে না পারলে এবং মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ এই যার দর্শন, তাকে দমিয়ে রাখা কঠিনই বটে। তাই তিনি অদম্য। অদম্য শেখ হাসিনা।

বিশিষ্ট সাংবাদিক আরিফুর রহমান দোলন সম্পাদিত ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ সংকলনগ্রন্থটি যেন এক অবিসংবাদি মানবী শেখ হাসিনাকে জানার পাশাপাশি সময় আর ইতিহাসের অলিগলিতে পর্যটন। গৌরচন্দ্রিকায় তাই সম্পাদক বলেন, ‘এটি সময়কে ধারণ করে কালেরও দলিল’। বিভিন্ন মনন ও রূপে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতি আর ব্যক্তি শেখ হাসিনা উঠে এসেছেন নানা ক্ষেত্রের ৬১ জন বিশিষ্টজনের লেখায়। তাকে দেখা যাবে যেমন দেশের উন্নয়নযাত্রায়, তেমনি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায়। কী মানবিকতায়, কী সমাজ-রাষ্ট্রদর্শনে। যেমন কূটনীতিতে, তেমনি অর্থনৈতিক রাজনীতিতে। শান্তি স্থাপন, আত্মসম্মানের দড়তা আর সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে রেখেছেন বুকে করে।

একটা কথা বলে নিই, বইটি পড়ে পাঠক বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার আটপৌরে কিন্তু ব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল এক মানুষের গুণমুগ্ধ হবেন অবলীলায়। কখনো বা হবেন অশ্রুসিক্ত। আবার এই সফল রাষ্ট্রনায়ককে কোনো অভিধায় রাঙিয়ে নিজের মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটানোর পর মনে হবে এ বুঝি যথেষ্ট নয়। যেমন হয় না একটি পাপড়ির বর্ণনা করে ফুলের পূর্ণ ব্যাখ্যা। ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ বইটি যেন কলি থেকে দল-বৃন্ত, পরাগ-রেণু, গন্ধ-বর্ণ আর সতেজ পাপড়ি মিলে আনন্দ-বেদনার সৌন্দর্য ছড়ানো এক পুষ্পগাথা। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তার ‘ভেতরের চোখ’ কাব্যে বলেন, ‘সেই চোখে অশ্রু নিয়ে শোকার্ত স্বদেশ।… যেন চলে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল… দেখে প্রিয় বাংলাদেশ বিপন্ন স্বদেশ।’ নিজের বিপন্নকালে আমাদের বঙ্গকন্যা এমনই এক শোকার্ত দেশকে শোকমুক্ত করতে, উজ্জীবিত করতে হাত উঁচিয়ে বরাভয় দেন। আর তাতে- ‘মিলেছে মাটির ডাকে সেই ভগ্নি-মাতা মিশিছে প্রাণের তাপের কোটি কোটি চোখ।’

নানা বিদগ্ধজনের লেখায় ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ বইয়ে উঠে এসেছে অদম্য শেখ হাসিনা, অদম্য বাংলাদেশ, অদম্য সময়, অদম্য কাল ও ইতিহাস। বই সমালোচনার সাধারণ প্রত্যয়টি প্রতিধ্বনি করে বলি- এক মলাটে পূর্ণাঙ্গ শেখ হাসিনা-বৃত্তান্ত এটি। লেখক তালিকায় আছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, ভাষাসংগ্রামী আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান থেকে হালের তরুণ লেখক পর্যন্ত। সাংবাদিক আবেদ খান, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবী মওদুদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, লেখক-সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক, সম্পাদক আরিফুর রহমান দোলন, সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রভাষ আমিনদের ভাবনার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতো নানা ক্ষেত্রের প্রবীণ-নবীন আলোকিত জনেরা। লেখক সূচিতে আরও আছেন- আনোয়ারা সৈয়দ হক, কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ড. এ কে আব্দুল মোমেন, মোহাম্মদ জমির, মোস্তাফা জব্বার, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, আলী কবীর, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, ড. হারুন অর রশিদ, মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.), মুহাম্মদ সামাদ। কামাল চৌধুরী, অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ, অজয় দাশগুপ্ত, এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, ফরিদুন্নাহার লাইলী, স্বদেশ রায়, আকরাম খান, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, শফী আহমেদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, শাবান মাহমুদ, মাহবুব রেজা, মাসুদ কামাল, ড. মিল্টন বিশ্বাস, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, মাহবুবুল হক শাকিল, ড. সেলিম মাহমুদ, ড. মো. হুমায়ুন কবীর, ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী, ডা. নুজহাত চৌধুরী, কাওসার রহমান, অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর, মনিরুজ্জামান মনির, মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু, রোকেয়া প্রাচী, স্বকৃত নোমান, শিবলী কায়সার, ড. বদরুল হাসান কচি ও হাবিবুল্লাহ ফাহাদ। এ ছাড়া ‘লেখক শেখ হাসিনা: কয়েকটি নিদর্শন’ অংশে তুলে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু-কন্যার তিনটি লেখা- ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘স্মৃতিতে অমলিন’ ও ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।

ধ্রুব এষের আঁকা সুন্দর প্রচ্ছদশোভিত এই বইয়ের প্রতিটি লেখা সাজানো হয়েছে প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক ছবি দিয়ে। এই অঙ্গসজ্জা বইটিকে করেছে আরও ঋদ্ধ। এই সময় পাবলিকেশন্সের প্রকাশিত ৩৪৩ পৃষ্ঠার ‘অদম্য শেখ হাসিনা’ বইয়ের মুদ্রিত মূল্য ৬০০ টাকা।

লেখক: মোরশেদুল জাহের , সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।