জাতীয়

পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা ; ‘কোরআন অবমাননার প্রমাণ মেলেনি’

By Daily Satkhira

November 01, 2020

অনলাইন ডেস্ক : লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে রংপুরের আবু ইউসুফ শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। জুয়েলের বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার প্রমাণ মেলেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে বীভৎস ও মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। জুয়েলের বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে মসজিদের খাদেম, ডেকোরেটর মালিক ও ইউপি সদস্যকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি কোনোভাবেই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে বাসা থেকে মোটরসাইকেলে এক বন্ধুকে নিয়ে বের হন জুয়েল। এরপর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের সবচেয়ে বড় মসজিদে বন্ধুকে নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করেন।

মানসিক ভারসাম্যহীন জুয়েল মসজিদের খাদেম জাবেদ আলীকে বলেন, মসজিদের সেলফে অস্ত্র আছে, আমি চেক করবো। এরপর সেলফে থাকা কোরআন ও হাদিসের বই দেখতে থাকেন। এ সময় জুয়েল অসংলগ্ন কথাবার্তা বলায় খাদেম জাবেদ আলী মসজিদের পাশে থাকা ডেকোরেটর দোকানের মালিক হোসেন আলীকে ডেকে আনেন। মসজিদের খাদেমের কথা শুনে হোসেন আলী জুয়েলকে মারধর শুরু করেন। এরপর তাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়।

এদিকে জাবেদ আলী ও ডেকোরেটর দোকানদার প্রচার করতে থাকেন তারা পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছেন। মুহূর্তের মধ্যে একথা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম জুয়েলের শার্টের কলার ধরে মারতে মারতে জাবেদ আলী ও হোসেন আলীকে বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং সেখানেও মারধর করেন।

এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা জুয়েল ও তার সঙ্গীকে গণপিটুনি দেন। খবর পেয়ে বুড়িমারীতে অবস্থানরত পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম এবং পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত ঘটনাস্থলে গিয়ে জুয়েল ও তার বন্ধুকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েন। পরে ইউএনও ও উপজেলা চেয়ারম্যান জুয়েলের বন্ধুকে নিয়ে বুড়িমারী স্থলবন্দরে ন্যাশনাল ব্যাংকে আশ্রয় নেন।

অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদের কলাপসিবল গেট ও দরজা ভেঙে শত শত জনতা জুয়েলকে বের করে গণপিটুনি দিতে দিতে বাইরে নিয়ে আসে। একপর্যায়ে তার মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেই উত্তপ্ত আগুনে জুয়েলকে নিক্ষেপ করে। ফলে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে দগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এরপরও বিক্ষুব্ধ জনতা তার পুরো শরীর জ্বলে অঙ্গার না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে এসে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করলে, জনতার ধাওয়া খেয়ে পুলিশ সদস্যরা ও ওসি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আহত হন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। প্রায় দুই ঘণ্টার আগুনে জুয়েলের শরীর ভস্মীভূত হয়। পরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও ততক্ষণে জুয়েলের ২-৩টি হাড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, একজন নিরাপরাধ মানুষকে এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে লাশ পর্যন্ত ভস্মীভূত করার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। তদন্তে জুয়েলের কোরআন অবমাননার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নিহত জুয়েলের বাবা ওয়াজেদ আলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুলের শ্বশুর প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও এমপি আবেদ আলী ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ ছাড়াও নিহত জুয়েলের বড় বোন হাসনা আখতার লিপির স্বামী কালীগঞ্জ উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান উপজেলা চেয়াম্যানের আত্মীয় বলেও গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পেরেছেন। নিহত জুয়েল এর আগেও অনেকবার কালীগঞ্জে বড় বোনের বাড়িতে এসেছেন, সেখান থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখাও করেছেন। ফলে জুয়েল যে মানসিক ভারসাম্যহীন সে বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যানও জানতেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

তবে জুয়েলকে মারধরের সময় তিনি এ কথা কাউকে বোঝাতে পারেননি। আবার জুয়েলকেই তখন মারধর করা হচ্ছে এটাও তিনি জানতেন কিনা সে বিষয়টিও প্রমাণসাপেক্ষ।

শনিবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদের শহীদ আফজাল হল কক্ষে বুড়িমারীর এ ঘটনায় আলেম সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছে প্রশাসন।

বৈঠকে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওহাব ভূঞা, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) দেবদাশ ভট্টাচার্য্য, জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু জাফর, পুলিশ সুপার (এসপি) আবিদা সুলতানা, পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহার, পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মোহন্ত উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ওই উপজেলার ইমাম মুয়াজ্জিনসহ পাঁচ শতাধিক আলেম উপস্থিত থেকে বুড়িমারী মসজিদের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। গুজব না ছড়িয়ে তদন্ত সংস্থা ও প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আলেম সমাজের প্রতি আহ্বান জানান প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা।

বৈঠক শেষে নিহত জুয়েলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়।

এদিকে ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অপরদিকে র‍্যাবের পক্ষ থেকেও ছায়া তদন্ত করা হচ্ছে।

লালমনিরহাট জেলার পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা বলেছেন, তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে পাটগ্রাম থানায়, এসব মামলায় শত শত মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামিও যেমন আছে, তেমনি নাম উল্লেখও করা হচ্ছে।

তিনি জানান, পুলিশ এখন ভিডিও ফুটেজ ধরে ধরে আসামিদের চিহ্নিত করছে। এরই মধ্যে বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ অব্যহত রয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানা গেছে। কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীরের (জেলা ও দায়রা জজ) নেতৃত্বে দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে।