জাতীয়

লেকহেড স্কুলের রেজোয়ান হারুন ঢাকায় এসে লাপাত্তা!

By Daily Satkhira

May 14, 2017

জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে অভিযুক্ত লেকহেড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা রেজোয়ান হারুন লন্ডন থেকে তিন দিন আগে ঢাকায় এসে  লাপাত্তা হয়ে গিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন রেজোয়ান হারুন। এরপর তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে  ইমিগ্রেশন পার হয়ে যান। বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে গ্রেফতারে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

রেজোয়ানের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন ও মদদের অভিযোগ রয়েছে। তিনি জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়া ঢাকার লেকহেড গ্রামার স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই স্কুলে আলোচিত অনেক জঙ্গি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে রেজওয়ান হারুনকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই চিঠির আলোকে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উপ-সচিব হাবিব মো. হালিমুজ্জামান স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ সদর দফতর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।

পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এ বিষয়ে খোঁজ করছি।

সূত্র জানায়, রেজোয়ান হারুন বাংলাদেশি দু’টি পাসপোর্ট একসঙ্গে ব্যবহার করতেন। তার একটি পাসপোর্ট নাম্বার বিএইচ ০৬৩৪১৩৭। ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইস্যু হওয়া এই পাসপোর্টের মেয়াদ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এছাড়া তার আরেকটি পাসপোর্ট নম্বর এই ৬০১৬৯৩৩। ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর ইস্যু হওয়া এই পাসপোর্টটি চলতি বছরের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে। রেজোয়ান হারুনের বিরুদ্ধে ঢাকার সামুরাই কনভেনশন সেন্টারে প্রচলিত ইসলামিরীতির বিরুদ্ধে গিয়ে একদিন আগের ঈদের জামায়াত আদায়, বাসায় জুম্মার নামাজ আদায় করার রীতি প্রচলের চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে ধানমন্ডির ৬/এ সড়কে প্রতিষ্ঠিত হওয়া লেকহেড গ্রামার স্কুলের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই স্কুলের বনানী ও গুলশানে আরও দু’টি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন এই স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন জেনিফার আহমেদ, যিনি বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীর সংগঠিত করার অন্যতম প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। জেনিফার নিজেও হিযবুতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই স্কুল প্রথম আলোচনায় আসে। ওই বছরই এই স্কুল পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব নেন হারুন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কর্ণধার হারুন অর রশিদ ও তার ছেলে রেজোয়ান হারুন। শুরু থেকেই এই স্কুলে এমন শিক্ষকরা কর্মরত ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। নেপথ্যে থেকে তাদের সাংগঠনিক কাজকর্ম সম্পাদন করতেন রেজোয়ান হারুন। বেশিরভাগ সময় লন্ডনে থাকলেও চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য চলাফেরা বন্ধ করে আত্মগোপন চলে যান তিনি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ  ফাঁকি দিয়ে শুক্রবার দেশে ঢুকলেও পরে আত্মগোপনে চলে যান।

সূত্র জানায়, রেজোয়ান হারুনের লেকহেড গ্রামার স্কুলে আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গ্রেফতার হওয়া রাজীব করিম, তার ভাই তেহজিম করিম ও তেহজিবের স্ত্রী সিরাত করিম শিক্ষক ছিলেন। ২০১০ সালে ইয়মেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযোনে গ্রেফতার হয়েছিলেন তেহজিব করিম। তেহজিবের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া মাইনুদ্দিন শরীফও এই স্কুলে শিক্ষকতার করতেন। এছাড়া পরিবারসহ সিরিয়ায় চলে যাওয়া মাইনুদ্দিনের ভাই রেজোয়ান শরীফও এই লেকহেডের শিক্ষক ছিলেন।

দায়িত্বশীল একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রেজোয়ান হারুনের সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা কারাবন্দি জসিমউদ্দিন রাহমানী, আনসারুল্লাহার আরেক শীর্ষ নেতা রেজওয়ানুল আজাদ রানা, পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশি জঙ্গি ইফতেখার আহমেদ সনি, জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে অভিযুক্ত ও নিখোঁজ হওয়া ফারজাদ হক তুরাজ, জুবায়েদুর রহমান, তাসনুভা হায়দার, ইয়াসিন তালুকদার, আরিফুর রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন সময়ে রেজোয়ান হারুনের লেকহেড গ্রামার স্কুলে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন। এমনকি হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণদাতা সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামও লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে জাহিদ মারা যায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রেজোয়ান হারুন নর্থসাউথসহ উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের জঙ্গিবাদে মোটিভেটেড করার কাজ করে থাকেন। তার নির্দেশনায় কায়াকুশিন নামে একটি মার্শাল আর্ট শেখা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানে মার্শাল আর্ট শিখতে গিয়েই সর্বশেষ মাস তিনেক আগে বনানীর বাসিন্দা সাঈদ আনোয়ার খাঁন নামে এক তরুণ নিখোঁজ হয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রেজোয়ান হারুন ব্রিটেনে থাকা অবস্থায় জামায়াতুল মুসলেমিন নেতা আবু ইসা আল রাফাই (জর্ডান থেকে ব্রিটেনে বসবাসকারী) এর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে মোটিভেটেড হয়। ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে সে জামায়াতুল মুসলেমিন সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। আল-কায়েদার অনুসারী জামায়াতুল মুসলেমিন বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত তরুণদের দলে ভেড়ানো শুরু করে। জামায়াতুল মুসলেমিন প্রথমে দেশের ১৩ জেলায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৫ সালে ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়ার পর তারা আরসিইউডি (রিসার্স সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট) ছদ্মবেশে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। সর্বশেষ জামায়াতুল মুসলেমিনের আমির ছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজাউর রাজ্জাক। রেজোয়ান হারুন ও রেজাউর রাজ্জাক মিলে আরসিইউডি পরিচালনার নামে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর ড. রেজাউর রাজ্জাক মালয়েশিয়া পালিয়ে যান।