অনলাইন ডেস্ক : দক্ষ জনবল এবং প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা উপকরণ ছাড়া অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালটি। অদক্ষ ওয়ার্ডবয়, বাবুর্চি, রিসেপশনিস্ট ও দারোয়ান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হতো রোগীদের। এমনকি চিকিৎসা দেয়ার নামে রোগীদের শারীরিক নির্যাতন করা হতো।
এরই ধারাবাহিকতায় মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে আসা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে সিগারেট খাওয়ানোর কথা বলে হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ‘অ্যাগ্রেসিভ প্যাসেন্ট ম্যানেজমেন্ট রুমে’জোরপূর্বক তাকে ঢুকিয়ে উপুড় করে আসামিরা দুই হাত পিঠ মোড়া করে বাঁধে। বাঁধতে বাঁধতেই ঘাড়ে, মাথায়, পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করে আনিসুল করিমকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা।
এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ, কয়েকজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
৯ নভেম্বরের ওই ঘটনার পর ১০ নভেম্বর আদাবর থানায় আনিসুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে ১৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
এরা হলেন—মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, পরিচালক ফাতেমা খাতুন ময়না, মুহাম্মদ নিয়াজ মার্শেদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মো. মাসুদ, ওয়ার্ডবয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট মো. তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, মো. লিটন আহাম্মদ, মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। এদের মধ্যে মামুন একমাত্র আসামি হিসেবে জামিনে রয়েছেন। বাকিরা কারাগারে। এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন দুই আসামি- সাখাওয়াত হোসেন ও সাজ্জাদ আমিন।
গ্রেফতার আসামিদের মধ্যে মাসুদ, অসীম, আরিফ মাহমুদ, সজীব চৌধুরী, তানভীর হাসান ও তানিম মোল্লা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে তারা জানান, ৯ নভেম্বর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে সিগারেট খাওয়ানোর কথা বলে মাইন্ড এইড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অ্যাগ্রেসিভ ম্যানেজমেন্ট রুমে জোরপূর্বক তাকে ঢুকানো হয়। ওই রুমে নিয়ে তাকে উপুড় করে শুইয়ে আসামিরা দুই হাত পিঠ মোড়া করে বাঁধেন। বাঁধার সময় ঘাড়ে, মাথায়, পিঠে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপর্যপুরী আঘাত করা হয়। এভাবে আনিসুল করিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
২০ শতাংশ কমিশনে মাইন্ড এইডে রোগী পাঠাতেন ডা. মামুন এদিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসামি ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সরকারি কাজের পাশাপাশি মাইন্ড এইড হাসপাতালে রোগী পাঠাতাম। রোগী পাঠানোর জন্য হাসপাতালের পক্ষ থেকে মোট বিলের ২০ শতাংশ হারে কমিশন পেতাম।’
তাকে দুদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আসামি মামুন ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়োগ পাওয়া একজন সহকারী চিকিৎসক। মামলার ভিকটিম আনিসুল তার আত্মীয়-স্বজনসহ ৯ নভেম্বর জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসেন। সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বুঝিয়ে আনিসুলকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে পাঠান তিনি। ডা. মামুন নিয়মিত মাইন্ড এইড হাসপাতালে রোগী দেখেন। একজন সহকারী চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বেসরকারি ও অবৈধভাবে পরিচালিত মাইন্ড এইড হাসপাতালে পাঠাতেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাইন্ড এইড হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, বাবুর্চি, রিসিপশনিস্ট, দারোয়ানসহ কয়েকজন কর্মচারী চিকিৎসা নিতে আসা আনিসুলকে চিকিৎসার নামে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন। যার ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মামলার এজাহারনামীয় গ্রেফতার আসামিদের আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিদের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ডা. মামুন সরকারি কাজের পাশাপাশি মাইন্ড এইড হাসপাতালে রোগী পাঠান। রোগী পাঠানোর জন্য হাসপাতাল থেকে তাকে মোট বিলের ২০ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা পলাতক আসামিদের অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। মামলার তদন্তকাজ অব্যাহত আছে এবং আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
সেবার উপকরণ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা হয় মাইন্ড এইড অন্যদিকে মামলায় হাসপাতালটির পরিচালক ফাতেমা খাতুন ময়নাকে চারদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন, ‘দক্ষ জনবল এবং প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা উপকরণ ছাড়া অবৈধভাবে হাসপাতালাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। অদক্ষ ওয়ার্ডবয়, বাবুর্চি, রিসিপশনিস্ট ও দারোয়ান দিয়ে রোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা হতো। চিকিৎসা দেয়ার নামে শারীরিক নির্যাতন করা হতো রোগীদের। এরই ধারাবাহিকতায় আনিসুল করিমকে চিকিৎসা দেয়ার নামে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামি ফাতেমা খাতুন ময়না মাইন্ড এইড হাসপাতালের একজন মালিক। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার অনুমোদন ব্যতীত তারা অবৈধভাবে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। জরুরি সেবা দেয়ার জন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, আইসিইউ, ইসিজি মেশিন ও অন্যান্য জরুরি উপকরণ ব্যতীতই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো কোনো উপকরণ হাসপাতালটিতে নেই। হাসপাতালে দক্ষ জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল বলে ফাতেমা খাতুন ময়না জানিয়েছেন।
এছাড়া মাইন্ড এইড হাসপাতালের কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সজীব, ওয়ার্ডবয় লিটন, জোবায়ের হোসেন সুজন ও সাইফুল ইসলাম পলাশকে সাত দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে আরেকটি প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আসামিরা পুলিশ হেফাজতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এছাড়া ছয় আসামির আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাদের সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ পেয়েছে। হাসপাতালের সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আসামিদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। আসামিরা একই উদ্দেশ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ৯ নভেম্বর আনিসুল করিমকে মানসিক রোগের চিকিৎসা দেয়ার নামে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আসামিদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে আনিসুল করিম শিপনের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমার একমাত্র সম্বল ছিল শিপন। অসুস্থবোধ করায় তাকে চিকিৎসার জন্য মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করাটা আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। হাসপাতালের কর্মচারীরা আমার ছেলেকে হত্যা করে আমার সম্বল কেড়ে নিয়েছে। আমি পুত্রশোকে এখন দিশেহারা। আমার পুত্রকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপন হত্যা মামলাটির তদন্তের কাজ গুরুত্বসহকারে চলছে। এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছয়জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। রিমান্ডে ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ঘটনার সাথে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’