অনলাইন ডেস্ক : বিশ্ববাজারে চীনের বাণিজ্যদূত তিনি। ফোর্বস পত্রিকার বিচারে পৃথিবীর ৫০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মধ্যে ২১তম স্থানে তার অবস্থান। স্টার্ট আপ বিজনেসের ক্ষেত্রে তাকে রোলমডেল বলে ধরা হয়। ধনকুবের শিল্পপতির পাশাপাশি তিনি একজন বিনিয়োগকারী, সমাজসেবী এবং উদ্যোক্তা। একইসঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক অর্থনীতির তীব্র সমালোচক। এমন জ্যাক মা-র অতর্কিত লাপাত্তা হয়ে যাওয়া ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোকে।
শূন্য থেকে শুরু করে কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন ফরচুন পত্রিকার বিচারে বিশ্বের ৫০ জন সেরা নেতার মধ্যে অন্যতম? দেখে নেওয়া যাক জ্যাক মা’র চলার পথ। চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের হাংঝৌতে তার জন্ম ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। জন্মের পরে তার নামকরণ হয়েছিল মা ইউন। খুব ছোট থেকে ইংরেজি শিখতে শুরু করেছিলেন নিজের চেষ্টায়। স্থানীয় হোটেলগুলোতে গিয়ে তিনি ইংরেজিতে কথা বলতেন পর্যটকদের সঙ্গে। যাতে ইংরেজিতে পোক্ত হতে পারেন।
পরে ওই পর্যটকদের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ রাখতেন। পত্রমিতালির সাহায্যে চর্চা চালাতেন ইংরেজি ভাষার। কিন্তু তার দূরের বন্ধুরা কেউ চীনা নাম উচ্চারণে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। তাই তাদের সুবিধার জন্য তিনি ‘জ্যাক’ নাম নিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে বহু চেষ্টায় কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন জ্যাক মা। চীনা শিক্ষাব্যবস্থায় কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বছরে একবার। তিনবারের চেষ্টায় তিনি সফল হন সেই পরীক্ষায়।
হাংঝৌ টিচার্স ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৮ সালে তিনি স্নাতক হন কলাবিভাগে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের নাম হাংঝৌ নর্মাল ইউনিভার্সিটি। তার কোর্সের অন্যতম বিষয় ছিল ইংরেজি।
জ্যাক মা-এর দাবি, তিনি ১০ বার চেষ্টা করেছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই তাকে ফিরিয়ে দেয় এই নামী প্রতিষ্ঠান। পরে তিনি হাংঝৌ ডিয়ানঝি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বিশ্ববাণিজ্য বিষয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।
প্রত্যাখ্যানের ব্যর্থতা সহ্য করতে হয়েছে এর পরেও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন অন্তত ৩০ বার চাকরির চেষ্টায় তার মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার কথায়, তিনি পুলিশের চাকরি খুঁজতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শুনতে হয়েছিল, তিনি এই কাজের যোগ্য নন।
তার শহরে যখন কেএফসি এসেছিল, বাকি যুবকদের সঙ্গে মা-ও দাঁড়িয়েছিলেন লাইনে, চাকরিপ্রার্থী হয়ে। মোট ২৪ জন ছিলেন। কিন্তু জ্যাক মা-কে বাদ দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন বাকি ২৩ জনই।
বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে সবসময়েই উজানস্রোতে গা ভাসাতে চেয়েছেন জ্যাক মা। ১৯৯৪ সালে জীবনে প্রথম বার ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। সে বছরই শুরু করেছিলেন নিজের সংস্থা, হাংঝৌ হাইবো ট্রান্সলেশন এজেন্সি।
১৯৯৫ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমেরিকায় গিয়েছিলেন জ্যাক মা। তখনই বুঝতে পেরেছিলেন আগামী দশক হতে চলেছে ইন্টারনেটের। সে বছরই স্ত্রী ও বন্ধুদের সঙ্গে ‘চায়না ইয়েলো পেজেস’ নামে একটি ওয়েবসাইট শুরু করেন।
এর পর নিজের দেশে বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইট তৈরি করে পরবর্তী পর্যায়ের সলতে পাকাতে শুরু করেন মা। ১৯৯৯ সালে ১৮ জন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেন ‘আলিবাবা’। বিজনেস টু বিজনেস মার্কেটপ্লেস এই সাইট শুরু হয়েছিল তার নিজের বাড়িতে।
২০০৩ সালে শুরু করেন ‘তাও বাও’ এবং ‘আলিপে’। চীনের মাটিতে এই দু’টি ছিল ই বে এবং পে পাল-এর পরিবর্ত। এর ৯ বছর পরে আলিবাবা-র অনলাইন ভল্যুম এক্সচেঞ্জ এক বছরে পেরিয়ে যায় ১ লাখ কোটি ইউয়ান।
২০১৪ সালে আইপিও হিসেবে আলিবাবা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে পেরিয়ে যায় আড়াই হাজার কোটি ডলার। ‘ফোর্বস’ পত্রিকার বিচারে চীনের ধনী ব্যক্তি হন তিনি। মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৯৫০ কোটি ডলার।
এই ঘটনার ঠিক ২ বছর পরে এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত হন জ্যাক মা। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আলিবাবা’র বোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। গত বছর এপ্রিলে রিলায়্যান্স-ফেসবুক চুক্তি হতেই এশিয়ার ধনীতম ব্যবসায়ীর তকমা জ্যাক মা’র কাছ থেকে চলে আসে ভারতের মুকেশ আম্বানির কাছে।
রিলায়্যান্সের ৯.৯৯ শতাংশ শেয়ার ফেসবুক কিনে নেয়। সেই ঘোষণা হতেই লাফিয়ে বাড়তে থাকে রিলায়্যান্সের শেয়ারের দাম। শেয়ারের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় মুকেশের মোট সম্পত্তির মূল্য জ্যাক মা-র চেয়ে বেড়ে যায়।
মহামারীতেও বিশ্বের বাকি ধনকুবেরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্পত্তি বেড়েছে জ্যাক মা’র। মার্কিন আর্থিক সংস্থা ব্লুমবার্গের দাবি, আলিবাবা কর্ণধার জ্যাক মা’র মোট সম্পত্তির পরিমাণ বর্তমানে ৫ হাজার ৪০৮ কোটি ডলার। বিশ্বের প্রথম ৫০০ জন ধনকুবেরের মধ্যে তার স্থান এই সংস্থার বিচারে ২২ নম্বরে।
ফোর্বস পত্রিকার বিচারে বিশ্বের ২০তম ধনকুবের হলেন জ্যাক মা। চীনের নিরিখে তিনি এই মুহূর্তে দ্বিতীয় ধনকুবের। তাকে ছাপিয়ে চীনের ধনীতম ব্যক্তি হলেন ‘টেনসেন্ট’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার মা হুয়াতেং।
শোনা যাচ্ছে, সম্প্রতি চীনের অর্থনীতি নিয়ে জ্যাক মা’র মন্তব্য অপ্রীতিকর বলে মনে হয়েছে দেশটির সরকারের কাছে। গত ২ মাস ধরে এই ধনকুবেরের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার নিজের শো ‘আফ্রিকাস বিজনেস হিরোস’-এর চূড়ান্ত পর্বেও দেখা যায়নি তাকে।
দু’মাস আগে শাংহাইয়ের এক অনুষ্ঠানে বর্তমান চীন সরকারের নিন্দা করায় তার উপরে খোদ চীনা প্রেসিডেন্ট রুষ্ট ছিলেন বলেন দাবি বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের। এর জেরে জ্যা মা’র আরেক সংস্থা অ্যান্ট-কে আর্থিক নজরদারি সংস্থার কোপে পড়তে হয় বলেও শোনা যায়। তিন সন্তানের বাবা জ্যাক মা-কে সরকারের পক্ষ থেকে দেশ না ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
কয়েক মাস আগে চীন সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিষেবার সমালোচনা করে খবরে এসেছিলেন জ্যাক মা। পাশাপাশি চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বেইজিং সেটাও ভালভাবে নেয়নি।
সারাদিনে একাধিক বিষয় নিয়ে টুইট করতেন তিনি। কিন্তু সেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই প্রায় দু’মাস ‘উধাও’। শেষ টুইট করেছেন ১০ অক্টোবর। আলিবাবার এক মুখপাত্রের দাবি, সময়ের অভাবে টিভি শোয়ের বিচারক পদ থেকে সরে এসেছিলেন জ্যাক মা। কিন্তু তার বাইরে অন্য কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন শিল্পপতিকে? সদুত্তর নেই তার সংস্থা বা পরিবারের কাছে। এই প্রসঙ্গে নীরব চীন সরকারও।
ধনকুবেরের খোঁজ না মেলায় বাড়ছে রহস্য। তবে কি সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মাসুল দিতে হচ্ছে তাকে? বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের একাংশে তীব্র হচ্ছে জল্পনা। সূত্র: আনন্দবাজার