আওয়ামী লীগ

আ. লীগে দুর্বল চেইন অব কমান্ড : অনেকেই মানেন না কেন্দ্রের নির্দেশ

By Daily Satkhira

January 30, 2021

অনলাইন ডেস্ক : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত ও আস্থাশীল আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী। দলীয় সভানেত্রীর প্রশ্নে সবাই আপসহীন ও ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অনেকেই মানছেন না দলের ‘চেইন অব কমান্ড’। যে যার মতো চলছেন। ফ্রি-স্টাইলে করছেন ‘গালমন্দ’। জুনিয়ররা মানছেন না সিনিয়রদের। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে প্রকাশ্যে নেতিবাচক কথাবার্তা বলছেন তৃণমূলের অনেক নেতা।

কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেক সিদ্ধান্তই মানছেন না এমপি-মন্ত্রীসহ দলের জনপ্রতিনিধি ও জেলা-উপজেলার শীর্ষ নেতারা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চলছে পার্টি অফিসে নজিরবিহীন ‘তালা মারার’ প্রতিযোগিতা। চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের কাজ করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা।

সূত্রমতে, রাজপথে বিরোধী দলের আন্দোলন না থাকায় এখন নির্ভার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফাঁকা মাঠে আওয়ামী লীগ এখন নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দলটির সামগ্রিক ভাবমূর্তির ওপর। এসব কর্মকান্ডে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। এতে ক্ষুণœ হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় দলীয় ‘চেইন অব কমান্ড’ যে দুর্বল হয়ে পড়েছে, এসব ঘটনার বহিঃপ্রকাশ তারই ইঙ্গিত দেয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘সরকারি দলের রাজনীতি করার কথা ছিল বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। কিন্তু যে কারণেই হোক, বিরোধী দল সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে এখন খেলা হচ্ছে নিজেদের মধ্যেই। শাসক দলে অভ্যন্তরীণ দলাদলি বাড়ছেই। যা দলের সাংগঠনিক কাঠামো চরম দুর্বল করছে। ভবিষ্যতে বিরোধী দল ও জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে তখন এটা উপলব্ধি করা যাবে।’ সম্প্রতি বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও ফরিদপুরের সংসদ সদস্য যুবলীগ নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনসহ যারা অতিকথনে দলকে বিব্রত করছেন তাদের এই বাহাস দ্রুত বন্ধ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মীজানুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের কার্যক্রম যারা করছে, তাদের এখনই কেন্দ্র থেকে থামানো উচিত। কেন্দ্রের কথা না মানলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে।’

সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাগযুদ্ধ শুরু হয় রাজধানীতেই। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দোকান বরাদ্দে অনিয়ম ও ৩৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলার আবেদন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাবেক ও বর্তমান মেয়রের মধ্যে বাহাস। এই মামলার জন্য বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে দায়ী করেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এরপর ৯ জানুয়ারি রাজধানীতে এক মানববন্ধন করে সাঈদ খোকন অভিযোগ করেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা তার নিজের মালিকাধীন মধুমতি ব্যাংকে জমা করে লভ্যাংশ খাচ্ছেন। তাপসকে দুর্নীতিবাজ দাবি করে তার মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। জবাবে মেয়র তাপস সাঈদ খোকনের বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই এবং ‘মানহানিকর’ জানিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত দেন। এরপর সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলার আবেদন করেন দুজন আইনজীবী। আবার সাঈদ খোকন বলেন, ‘তাপসের মানসম্মানের বাজারমূল্য কত, আমি তা যাচাই করব’।

তাপস-সাঈদ খোকনের বাহাসের মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে তোলে নোয়াখালীর বসুরহাটের পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জার বক্তব্য। তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী ও ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীকে নিয়ে কড়া বক্তব্য দেন। তাদের ইঙ্গিত করে সুষ্ঠু ভোট হলে ২-৪টা বাদে বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবেন না বলেও বক্তব্য দেন মির্জা। একই সঙ্গে তার বিজয় ঠেকাতে সন্ত্রাসী বাহিনী পাঠানোর অভিযোগ তোলেন এই দুই নেতার বিরুদ্ধে। এখানেই শেষ নয়, কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি এবং যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপি সম্পর্কেও নানা নেতিবাচক বক্তব্য দেন। তারা প্রত্যেকেই দলীয় পদ-পদবিতে কাদের মির্জার চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আওয়ামী লীগের শিষ্টাচার হলো সিনিয়র নেতাকে সম্মান করা। তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা না বলে প্রয়োজনে দলীয় ফোরামে কথা বলা। কাদের মির্জার বক্তব্যের সূত্র ধরে ফরিদপুরের স্বতন্ত্র এমপি ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন তাকে (কাদের মির্জা) পাবনার মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন। কাদের মির্জাও নিক্সনের বক্তব্যের কড়া জবাব দেন। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর একটি মন্তব্য। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন। এর দুই দিনের মাথায় বেসরকারি টেলিভিশনের একটি সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে এসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং নোয়াখালীবাসীর কাছে ক্ষমা চান একরামুল করিম চৌধুরী।

ফরিদপুরেই চলছে দুই নেতার বাহাস। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। গত দুই নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি তিনি। এখানে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে এমপি হয়েছেন মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী। এ আসনে (ফরিদপুর-৪ ভাঙ্গা, সদরপুর, চরভদ্রাসন) কাজী জাফরউল্লাহ এবং মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ সক্রিয়। নিক্সন চৌধুরী মাঝে-মধ্যেই কাজী জাফরউল্লাহকে গালমন্দ করে বক্তৃতা করেন, যা প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও পুরনো। বয়স ও দলীয় স্ট্যাটাসে কাজী জাফরউল্লাহ এমপি নিক্সন চৌধুরীর বড়। কিন্তু শিষ্টাচার মেনে চলতে বা এই সিনিয়র নেতা সম্পর্কে আর তির্যক মন্তব্য না করতে নিক্সনকে মানা করেননি কেউ। এদিকে অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যালয় দখল নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এজন্য দলীয় কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি ‘তালা মারার’ ঘটনাও সারা দেশে আলোচনায় এসেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সদরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি এতদিন জাফরউল্লাহর সমর্থকদের দখলেই ছিল। নিক্সন চৌধুরী আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সম্প্রতি তার অনুসারীরা ওই কার্যালয়ে তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে কাজী জাফরউল্লাহর ছবি ভাঙচুর করেন এবং কার্যালয় দখলে নেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক স্থানে সরাসরি নৌকার বিরোধিতা করার অভিযোগ উঠেছে দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও জেলার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। নোয়াখালীর চৌমুহনীর এমপি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন তার আপন ভাইকে। বরগুনার এমপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সবাই সব জানেন, তারপরও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব ঘটনায় রাজশাহী বিভাগে একজন প্রতিমন্ত্রী, দুজন এমপি, সিলেট বিভাগে একজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন এমপি, বরিশাল বিভাগে দুজন এমপি, ঢাকা বিভাগে একজন এমপি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে একজন এমপিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের ঢাকায় ডেকে পাঠানো হতে পারে। সূত্র : বাংলাদেশপ্রতিদিন