মাত্র পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের সাংসদ বজলুল হক হারুনের (বি এইচ হারুন) পরিবার বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, তার স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই বি এইচ হারুনের। ধর্ম মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বি এইচ হারুনের বিপুল সম্পদের সামান্য অংশ হচ্ছে রাজধানীর বনানীর বহুল আলোচিত দ্য রেইনট্রি হোটেল। কাগজে-কলমে হোটেলটির মালিকানা বি এইচ হারুনের স্ত্রী, তিন ছেলে ও মেয়ের নামে। আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা এই বাণিজ্যিক হোটেল তৈরি করা হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া। গত ২৮ মার্চ হোটেলটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হন। বনানী থানা শুরুতে তাঁদের অভিযোগ আমলে নিতে চায়নি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সমাজের নানা স্তরে ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় হয়। পরে আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে শাফাত আহমেদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য রেইনট্রি ঢাকা লিমিটেড’ নামে যে কোম্পানি নিবন্ধিত হয়, তারই সংক্ষিপ্ত নাম রেইনট্রি হোটেল। এর পরিচালকেরা হলেন বি এইচ হারুনের স্ত্রী মনিরা হারুন, তিন ছেলে শাহ মো. নাহিয়ান হারুন, শাহ মো. আদনান হারুন ও মাহির হারুন এবং মেয়ে হোমায়রা হারুন। শাহ মো. আদনান হারুন হোটেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বি এইচ হারুনের নামে থাকা জমিতে হোটেলটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালে আর বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু হয় চলতি বছরের শুরুর দিকে। বেআইনিভাবে পরিচালিত হওয়ায় গত ১৫ এপ্রিল হোটেলটি সিলগালা করে দিয়েছিলেন রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই অভিযানে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। হোটেলের মালিকেরা ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই আবার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ পেয়ে যান। কিন্তু কীভাবে তৈরি হলো পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র না নেওয়া এ বিলাসবহুল হোটেল? অর্থই বা কোথা থেকে এল—এ অনুসন্ধান করতে সামনে চলে আসে সাংসদ বি এইচ হারুনের অন্য সব সম্পদের খবরও। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের ভগ্নিপতি হচ্ছেন বি এইচ হারুন। আবার বি এইচ হারুনের ছেলে বিয়ে করেছেন দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রকাশক-সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিনের মেয়েকে। বাহাউদ্দিনের বাবা মাওলানা আবদুল মান্নান, যিনি এরশাদ সরকারের ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। পাঁচ বছরে এত সম্পদ! ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় বি এইচ হারুন ৩৮ লাখ টাকার অর্থসম্পদ দেখান। এর মধ্যে রয়েছে শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাংকে ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা, বাড়ি/দোকান ভাড়া থেকে ১৬ লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে ১৪ লাখ টাকা এবং সম্মানী বাবদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয়। স্ত্রী মনিরা হারুনের নামে তখন কিছুই ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে হলফনামায় বি এইচ হারুন দেখান, তাঁর নিজের ও স্ত্রীর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নগদ ২ কোটি ৯০ লাখ, ব্যাংকে ৬৭ লাখ এবং ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, গাজীপুরে ১৭ কাঠা, মিরপুরে ৫ কাঠা, বনানীতে সাড়ে ৬ কাঠা, বারিধারায় ৬ কাঠার একটি ও সাড়ে ৪ কাঠার আরেকটি প্লট রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ছোট ছেলে আদনান হারুনকে দুটি জাহাজ কিনতে ১৩ কোটি টাকা এবং বড় ছেলে নাহিয়ান হারুনকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক হতে ২০ কোটি টাকা দেন। এ ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ভাই ফয়জুর রব আজাদের নামে জমা রাখেন ১৫ কোটি টাকা। শেষ হলফনামায় অবশ্য দায় হিসেবে বি এইচ হারুন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, স্ত্রীর কাছ থেকে ৩ কোটি ২০ লাখ এবং বৈদেশিক মুদ্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণ নেন বলে দেখান। এসবের বাইরেও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আটটি কোম্পানিতে মালিকানা রয়েছে বি এইচ হারুনের, এর মধ্যে পাঁচটিরই চেয়ারম্যান তিনি। অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বি এইচ হারুন গত বুধবার বলেন, ‘সম্পদ তো তেমন বাড়েনি। যেগুলো বলছেন, এগুলো আগে থেকেই ছিল।’ রেইনট্রি হোটেলসহ বহুতলবিশিষ্ট ভবনই নির্মাণ করা হয়েছে চার-পাঁচটি, অর্থের উৎস কী—এমন প্রশ্নের জবাবে বি এইচ হারুন বলেন, ‘ব্যাংকঋণ নিয়ে করেছি।’ রূপালী ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ তো নিলেন গত বছর আর ভবনগুলো নির্মাণ করেছেন তারও আগে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সব কথা টেলিফোনে বলা যাবে না।’ বিএনপির টিকিটে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠির ভান্ডারিয়া-কাউখালী আসন থেকে অংশ নিয়ে বর্তমান পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে তিনি জামানত হারিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন, কিন্তু মনোনয়ন পাননি। ১৯৯৮ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে জেলার রাজাপুর-কাঁঠালিয়া আসন থেকে ‘নৌকা’ প্রতীকে অংশ নিয়ে তৃতীয় হন। আগের দুবারের বিএনপির সাংসদ শাহজাহান ওমর জরুরি অবস্থার সময় বিদেশে থাকায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি এবং ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন বি এইচ হারুন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে প্রায় অর্ধেক সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তাঁদেরই একজন তিনি। ব্যাংকের গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ! প্রথমবার সাংসদ হওয়ার পর থেকেই অভিযোগ ওঠে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের গ্রাহক রুমি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী খলিলুর রহমানের ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বি এইচ হারুন। বি এইচ হারুন তখন প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক (বর্তমানেও পরিচালক)। খলিলুর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পৃথক আবেদনে জানান, সৌদি সরকারের সাহায্যে ২০০৮ সালে সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য ১৫ হাজার ঘর নির্মাণের ২০৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর হিসাব ছিল প্রিমিয়ার ব্যাংকের বংশাল শাখায় এবং কাজ চলাকালে ২৯৭টি চেকের পাতার মাধ্যমে ৭০ কোটি টাকা তিনি উত্তোলন করেন। কাজ শেষে বাকি টাকা তোলার জন্য খলিলুর বংশাল শাখায় গেলে তৎকালীন ব্যবস্থাপক সামসুদ্দিন চৌধুরী (পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে ডিএমডি) জানান, তিনি সব টাকা তুলে নিয়ে গেছেন এবং হিসাবও বন্ধ করে দিয়েছেন। খলিলুর দুই সংস্থাকে বলেছেন, তাঁর অজ্ঞাতে অতিরিক্ত ৩৮৮টি চেকবই ইস্যু দেখিয়ে জাল সইয়ের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছেন বি এইচ হারুন। ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে খলিলুরের হিসাবে ২০৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। বেশির ভাগ টাকা তোলা হয়েছে ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে, যা বি এইচ হারুনের অফিস থেকে ৫০ গজ দূরে। ওই সময় প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি ছিলেন খন্দকার ফজলে রশীদ। মাঝখানে কয়েক বছর ঢাকা ব্যাংকের এমডি থেকে বর্তমানে আবার তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি। বিদেশে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। খলিলুরের অভিযোগ, সামসুদ্দিন চৌধুরীর পাশাপাশি সুপরিকল্পিত এ জালিয়াতির সহযোগী ব্যাংকটির তৎকালীন অতিরিক্ত এমডি আবু হানিফ খান এবং বি এইচ হারুনের মালিকানাধীন আল হোমায়রা মেডিকেল সেন্টারের দুই হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা রাজা ও ফরিদউদ্দিন। গত রাতে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সামসুদ্দিন চৌধুরী এ ব্যাপারে কথা বলতে চাননি। গোলাম মোস্তফা রাজা বর্তমানে আলোচিত রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপক এবং গত মঙ্গলবার রেইনট্রি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। রুমি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী খলিলুর রহমান বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন যাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে মেরে ফেলার। বনানী ও গুলশান থানায় পাঁচটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচারপ্রার্থী।’
বি এইচ হারুন রিটার্ন দাখিল করেন না বিপুল সম্পদ বৃদ্ধির বিপরীতে কত টাকা আয়কর দেন বি এইচ হারুন? আয়কর অধ্যাদেশে বিধিনিষেধ থাকায় কারও আয়করের তথ্যই জানায় না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, অস্বাভাবিক আয় দেখানোটা মুশকিল বলেই আওয়ামী লীগের ২০০৯-১৪ সময়ের পাঁচ বছরে তিনি কোনো আয়কর দিতে চাননি। পুরোনো অর্থবছরসহ আয়কর আদায়ে তাঁর বিরুদ্ধে এনবিআর সাতটি মামলা দায়ের করেছিল। গত সোমবার ও মঙ্গলবার এনবিআরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত তিনি আয়করের ঝামেলাগুলো মিটিয়েছেন। কিন্তু দুই বছর ধরে আবার আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন না। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রিটার্ন দাখিল না করায় এনবিআর তাঁকে জরিমানা করেছে। তবে জরিমানার টাকা এখনো আদায় হয়নি বলে জানা গেছে। দুই বছর ধরে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করার কারণ জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার মুঠোফোনে বি এইচ হারুন বলেন, ‘যিনি এটা বলেছেন, ঠিক বলেননি। ফাইল সব ঠিকঠাক আছে।’ নিজ ব্যাংকের গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে পাঁচ বছরে এত সম্পদের মালিক হলেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বি এইচ হারুন বলেন, ‘এসব মিথ্যা অভিযোগ। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ সক্রিয় দুদক, নিষ্ক্রিয় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের জুলাইয়ে অভিযোগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও বি এইচ হারুনের বিরুদ্ধে পরে আর তা দেয়নি দুদক। এই ফাঁকে খলিলুরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির নামে নতুন প্রতারণা করেন বি এইচ হারুন। খলিলুরকে ৫ কোটি টাকার চেক দেন তিনি, কিন্তু সমঝোতা চুক্তিতে সই করেননি। অথচ ওই চুক্তিকে আমলে নিয়েই দুদক নথিভুক্ত (মামলা না করা) করে ফেলে ওই ঘটনা। পরে বি এইচ হারুনের নামে চেক ডিজ-অনারের মামলা করেন খলিলুর এবং আদালত থেকে মুচলেকা দিয়ে জামিন নেন বি এইচ হারুন। অন্য দুটি চেক ব্যাংকে উপস্থাপনের সময় আসেনি এখনো। তবে ইকবাল মাহমুদ দুদক চেয়ারম্যান হয়ে আসার পর বিষয়টি পুনরুজ্জীবিত হয়। সংস্থার উপপরিচালক সামছুল আলমকে প্রধান করে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত দল গত ৪ এপ্রিল প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডির কাছে তথ্য চায়। দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল গত মঙ্গলবার বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণ নেওয়া হচ্ছে। যত শক্তিশালীই কেউ থাকুন না কেন, পদক্ষেপ নিতে দুদক এক পা-ও পেছাবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও বেরিয়ে এসেছিল চেকবই ইস্যু রেজিস্টার ও কার্ডে রক্ষিত নমুনা স্বাক্ষরের সঙ্গে অনেক চেকের পাতায় থাকা খলিলুরের স্বাক্ষরের মিল নেই। স্বাক্ষরে মিল না থাকা সত্ত্বেও প্রিমিয়ার ব্যাংক কীভাবে টাকা দিল, সেই প্রশ্নও তুলেছিল। পরে আর এগোয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা গত বুধবার মুঠোফোনে বলেন, তিনি পুরো বিষয়টি জানেন না, জানতে চান না এবং জানাতেও চান না। জানাতে না চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘জনসমক্ষে বলার মতো ঘটনা এটা না।’ সূত্র : প্রথম আলো