বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-
” বিশ্রাম কাজের অংশ একসাথে গাঁথা… নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা…”
যারা সারা বছর কাজে থাকেন, বিশ্রাম তাদের কাজেরই অংশ হওয়া উচিত। সে বিবেচনায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সাতক্ষীরা’র বর্ণিল উদ্যোগে ঘুরে এলাম সুন্দরবনের ৬ টি স্পট — কটকা, জামতলা, কচিখালি, ডিমের চর, হাড়বাড়িয়া ও করমজল। ৪৮ ঘণ্টার এক মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ।
এই দেশকে যদি আমরা ভালোবাসি, তবে দেশের বন-জঙ্গল-নদী- সমুদ্রকে চিনতে হবে, জানতে হবে। গানের ভাষায় — ” পথ হারাবো বলে এবার পথে নেমেছি।” আসলে পথে নামলেই নতুন পথ চেনা যায়।
কটকার গহীন ঘন বন, পাশে বঙ্গোপসাগর ; টাইগার পয়েন্ট থেকে জামতলা বীচের গাঁ শিউরে উঠা বিস্তৃত পথ; কচিখালির দিগন্ত বিস্তৃত বনভূমি আর ফাঁকা মাঠ; ডিমের চরের সমুদ্র সৈকতের খোলা হাওয়া আর আকাশের নীলের স্নিগ্ধ পরশ পেয়ে অভিযাত্রী সকলেই প্রকৃতির কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। কমে গেছে মনের চাপ, রক্তের চাপ আর বেড়ে গেছে হৃদয়ের গতি। ফুরফুরে মেজাজে সবাই যেন বলেছে — প্রাণহীন শহরের ইটের পাঁজরের মর্মব্যাথা আর শুনতে চাই না। প্রত্যেকটা স্পটে গিয়ে অভিভূত হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি, খুলে গিয়েছে মনের জানালা। মনে পড়ে গেল কবিতার চরণ —
“দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশিরবিন্দু।”
কবিতাটির মর্মকথা বর্ণে বর্ণে উপলব্ধি করেছি। বাঙ্গালী প্রকৃত প্রস্তাবে ভমণ পিপাসু জাতি নয়। এদেরকে ভ্রমণে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা দরকার। আমি অন্তর থেকে উপলব্ধি করেছি, ভ্রমণে দেশপ্রেম বাড়ে, মনের আর্গল প্রসারিত হয়। আপনি নিজেও পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
এবার একটু ভিন্ন রূপে দুটি কথা বলতে চাই। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি — কটকা, হাড়বাড়িয়া, করমজলের ওয়াকওয়ের (ট্রেইলর) কাঠ এতটা দুর্বল, ভাঙ্গাচোরা যে এখানে দুর্ঘটনা ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অনেক বয়স্ক ও শিশুরা ট্যুরে যায় যাদের প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকির মধ্যে পা ফেলতে হয়।
কটকার টাইগার পয়েন্ট থেকে জামতলা সি বিচ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪ কিমি রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে সবাই প্রায় ক্লান্ত থাকে। আসা-যাওয়ার প্রায় ৮ কিমি রাস্তার মধ্যে বিশ্রাম নেবার মতো একটা কাঠের বেঞ্চ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। বন বিভাগ স্থানীয় কাঠ দিয়েও এটা করতে পারে ভ্রমণ পিপাসুদের সুবিধার জন্য। বনের মধ্যে প্রবেশের ওয়াকওয়ে ভাঙ্গা থাকবে কেন? এটা দেখে মনে পড়ল Samuel Taylor Coleridge এর বিখ্যাত উক্তি–
” Water water everywhere, nor a drop to drink” সুন্দরবনে গেওয়া, সুন্দরী, গরান,পাইন, লোহা কাঠের ছড়াছড়ি অথচ কাঠের তৈরি ওয়াকওয়ে (ট্রেইলর) ভাঙ্গা, বিপর্যস্ত।
বন বিভাগ বা পর্যটন বিভাগ ভ্রমণের জন্য সবাইকে কাগজে-কলমে উৎসাহিত করে থাকেন অথচ বনের মধ্যে প্রবেশ করলে বোঝা যায় কী অবহেলায় পতিত এই বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। বন বিভাগ বা পর্যটন বিভাগ কারোর কোনো দায় নেই? নাকি সবই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখবেন? তাহলে বাকিরা কী করবেন?
সুন্দরবনের স্পটগুলোতে বিস্তীর্ণ ভূমি পতিত পড়ে আছে। অনেক অপ্রয়োজনীয় গাছপালাও রয়েছে। আমার মনে হয়েছে লবণসহিষ্ণু ফলের গাছ দিয়ে গোটা সুন্দরবন এলাকা ছেয়ে দেয়া যেতে পারে। এতে দেশের ফলের চাহিদা পুরোটাই পূরণ হবে। আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা লবণাক্ত অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু ধান উৎপন্ন করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তাহলে লবণসহিষ্ণু ফল গাছ নয় কেন?
কৃতজ্ঞতা সহযাত্রী ভ্রমণপিপাসু সকলকে, কৃতজ্ঞতা Royal Magpie লঞ্চ মালিককে, যিনি নিজে আমাদের সঙ্গী হয়েছেন, যাতে আমাদের যাত্রায় কোন ত্রুটি না ঘটে।
দয়া করে আমার এই নাতিদীর্ঘ লেখাটাকে কেউ ধান ভানতে শীবের গীত শ্রেণির কিছু ভাববেন না। সুন্দরবনের সৌন্দর্যের বর্ণনা ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সাতক্ষীরা’র সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম দিয়েই যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও দেবেন। আমি কেবল সুন্দরবনকে ভালোবেসে এর অপার সম্ভাবনার কথা বললাম।
লেখক : সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা